কিভাবে অর্থ আয় ও ব্যয় করেন আধুনিক ইতিহাসের সেরা ধনী জেফ বেজোস
অতীতের সব নজির পদদলিত করে ইতিহাসের প্রথম ২০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন অ্যামাজনের মুখ্য নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। ফোর্বস ম্যাগাজিন বলছে, আধুনিক সময়ে তার আগে অন্য কাউকে এত বড় ধনী হতে দেখা যায়নি।
পুঁজিবাজার হলো; এক বন্ধুর পথ, কোথাও উঁচু, কখনোবা সামনে অতল গিরির খাঁদ। সেই পুঁজিবাজারেই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দরপ্রবৃদ্ধির সুবাদে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে অ্যামাজন নির্বাহীর। মহামারিতে মার্কিন জনজীবন আর অর্থনীতি বিপাকে পড়লেও, অ্যামাজনের জন্য শাপে বর হয়ে উঠেছে এ সঙ্কট। বেড়েছে তাদের অনলাইন ডেলিভারি বাণিজ্যের পরিধি, ফুলেফেঁপে উঠেছে ওয়েব সেবার ব্যবসাও।
তাই সাবেক স্ত্রী মেকেঞ্জি বেজোসকে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে অ্যামাজনে নিজ অংশীদারিত্বের ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা দেওয়া স্বত্বেও, পৃথিবীর সেরা ধনকুবেরের বিত্তের জৌলুস একটুও কমেনি।
ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিকতম হিসাবে, শুধু চলতি বছরেই ৮ হাজার ৭১০ কোটি ডলার যোগ হয় বেজোসের ধনভাণ্ডারে। বেজোস যখন প্রাচুর্য্যের শিখরে ঠিক তখনই মহামারি জনিত অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় সরকারি বেকার ভাতা পেতে আবেদন করেছে চার কোটি ৯০ লাখ মার্কিন নাগরিক।
তবে বেজোস একা নন। তিনি ছাড়াও আরো কিছু বিলিয়নিয়ার চলমান মহামারির মধ্যে আরো বেশি ধনী হয়ে উঠেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন; টেসলার মুখ্য নির্বাহী এলন মাস্ক এবং জুমের এরিক ইউয়ান। গত মার্চ থেকে জুন নাগাদ এদুজনের সম্পদের পরিমাণ দুইশ' কোটি ডলারেরও বেশি বাড়ে।
তবে অন্য ধনীদের প্রসঙ্গ ছেড়ে কিভাবে বেজোস এ বিপুল সম্পদ অর্জন করলেন এবং কিভাবে তা ব্যয় করেন, সেই তালিকায় নজর দেওয়া যাক।
যেভাবে আজ মহীরুহ অ্যামাজন:
সাল ১৯৯৪, অনলাইনে কেনাবেচায় বিশ্বের পথিকৃৎ কোম্পানি- অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করেন জেফ বেজোস। এ কোম্পানিটিই পরবর্তীকালে তার সিংহভাগ সম্পদ আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে।
ওয়ালস্ট্রিটের একটি লোভনীয় চাকরি ছেড়ে অনলাইনে বই বেচাকেনার সাইট খুলবেন শুনে শঙ্কিত হন, তার পরিচিতজনেরাই। ওই সময়ে ইন্টারনেট ভিত্তিক বাজার বিকাশের ধারণা ও ভবিষ্যৎ- সম্ভবত বেজোসের চাইতে ভালো করে অন্যরা কল্পনাও করতে পারেননি। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের প্রাথমিক যুগে সেটা অস্বাভাবিক চিন্তাও ছিল না।
বেজোসের দৃঢ় সংকল্পের কাছে হার মেনে অবশেষে এগিয়ে আসেন তার বাবা-মা। তারা দুজনে মিলে ছেলের কষ্টে গড়া ছোটখাট কোম্পানিতে প্রায় আড়াই লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন। আজ বেজোসের বাবা-মা'র করা সে বিনিয়োগ ফুলেফেঁপে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার কোটি ডলারে।
স্ত্রী ম্যাকেঞ্জিও সহায়তা করেছেন জেফের ব্যবসায়। তার তীক্ষ্ম হিসাবরক্ষণের গুণ ছিল, আবার আমাজনের প্রথম মালামাল সরবরাহের চুক্তিটিও তার অবদানেই সফল হয়। ২০১৯ সালে জেফের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ সমঝোতার আওতায় কোম্পানির ৪ শতাংশ সরাসরি অংশীদারিত্ব লাভ করেন ম্যাকেঞ্জি। তার নিজের ৬ হাজার ৪৪০ কোটি ডলারের সম্পদের একটি বড় অংশই এসেছে অ্যামাজন শেয়ার মালিকানা থেকে।
১৯৯৭ সালে প্রথম মার্কিন পুঁজিবাজারে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করে অ্যামাজন। প্রাথমিক শেয়ার বিক্রির ওই দিনের পর থেকে কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ারপ্রতি দর এক লাখ ৫৩ হাজার শতাংশ বেড়েছে।
অ্যামাজনের বিস্ময়কর উত্থান ইন্টারনেটের প্রথম যুগের অন্য প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোকে ধুলো চাটিয়ে ছাড়ে। কোম্পানির প্রথম আইপিও ছাড়ার পরবর্তীকালে শেয়ার হোল্ডারদের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠিতে বেজোস জানান, প্রথমদিকে অ্যামাজন ইন্টারনেটে পণ্য বিক্রয়কারী কিছু প্রতিযোগীর সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলে বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল আমেরিকা অনলাইন, প্রোডিজি এবং ইয়াহু'র মতো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কেউই পরিবর্তিত বাণিজ্যিক পরিবেশ আর অ্যামাজনের প্রভাবের মোকাবিলা করতে পারেনি। আলোচিত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সকলকেই পরবর্তীকালে অ্যামাজন বা অন্য বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়।
বিগত দুই দশকে অ্যামাজনের বাণিজ্যিক পরিধি ধারাবাহিকভাবে স্ফীত হয়ে। এখন প্রায় সকল ধরনের ডিজিটাল মিডিয়া, ভোক্তাপণ্য মিলবে অ্যামাজনের অনলাইন ভাণ্ডারে।
অ্যামাজনের ব্যবসায়িক পরিধি এখন বিস্তৃত ওয়েব সেবার ব্যবসাতেও। ব্যবসাটির পরিধি এখন আকাশচুম্বী। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ কোম্পানির ক্লাউড সেবা খাত থেকে আয় হয় সাড়ে ১৭শ' কোটি ডলার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ব্যবসা অধিগ্রহণেও বাড়ে অ্যামাজনের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য। ২০০৯ সালে অনলাইনে পাদুকা বিক্রেতা জাপ্পোস'কে ১২০ কোটি ডলারে কিনে নেয় অ্যামাজন। আট বছরের মধ্যে এটা ছিল কোম্পানিটির সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণের ঘটনা।
কিন্তু, নিজেদের তৈরি রেকর্ড নিজেরাই ভাঙতে পারঙ্গম কোম্পানিটি। ২০১৭ সালে সেটা আবারো প্রমাণিত হয় এক হাজার ৩৭০ কোটি ডলারে হোল সেল ফুডস নামক আরেকটি ব্যবসা অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
হোল সেল ফুডস অধিগ্রহণের ফলে মুদিপণ্যের ব্যবসা জগতে প্রবেশ করে অ্যামাজন। ২০১৯ সালের ওয়ানক্লিকরিটেইল নামক একটি অনলাইন বাণিজ্য বিশ্লেষক সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের মুদিপণ্য বাজারের ১৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে অ্যামাজন।
অ্যামাজনের সাফল্যমণ্ডিত উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বেজোসের আয়ের উৎস। বর্তমানে তিনিই অ্যামাজন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার। ই-কমার্স জায়ান্টের ১১ শতাংশের মালিক তিনি। বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ে সাবেক স্ত্রী মেকেঞ্জি'র এক বিবৃতি অনুসারে দম্পত্তির ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা জেফের ভাগেই পড়েছে। তাছাড়া, মেকেঞ্জিকে দেওয়া ২৫ শতাংশ শেয়ারের ভোটাধিকারটাও পেয়েছেন জেফ।
খরচেও যার আয় আর সম্পদ বাড়ে:
অন্য কোম্পানির ব্যবসাতেও বিনিয়োগ করেন বেজোস। ব্যক্তিগতভাবে যেমন তা করা হয়, তেমনি তার বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বেজোস এক্সপিডিশন্সও ব্যস্ত থাকে সম্ভাবনাময় ব্যবসা খুঁজে সেখানে বিনিয়োগে।
১৯৯৮ সালে গুগলে বিনিয়োগ করেন বেজোস। তিনি যদি অন্য ব্যবসা নাও করতেন, তারপরও গুগলের শুরুর দিকে করা এই বিনিয়োগ আজ তাকে বিলিয়নিয়ারের কাতারেই রাখত।
বেজোস এক্সপিডিশন্স অনেক ব্যবসার প্রাথমিক উদ্যোগে মূলধন দিয়েছে। রক্ত পরীক্ষার জৈব-প্রযুক্তি বিষয়ক ফার্ম গ্রেইল, জনপ্রিয় সফটঅয়্যার প্রস্তুতকারক ওয়েবসাইট স্ট্যাক ওভারফ্লো এবং মার্কিন গণমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার আজকের অবস্থানে এসেছে এই বিনিয়োগের সাহায্যেই। তবে ২০১৫ সালে বিজনেস ইনসাইডারের পূর্ণ মালিকানা কিনে নেয় এক্সেল স্প্রিঙ্গার। ফলে জেফ বেজোস আর প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারী নন।
গণমাধ্যম জগতে বেজোসের সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণ ২০১৩ সালে ২৫ কোটি ডলারে প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট কিনে নেওয়ার ঘটনা।
তার অধিগ্রহণের পর থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে বিস্তৃত হয় পোষ্টের সংবাদ পরিবেশনা। পাঠকসংখ্যাও বিস্ময়কর উত্থান দেখেছে এ সময়ে।
বেজোসের সম্পদ এত সুবিশাল যে, ২০১৮ সালে বিজনেস ইনসাইডার প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে জানানো হয়, ওই সময়ে তিনি ১৩ হাজার কোটি ডলারের অধিকারী ছিলেন। নিজ প্রয়োজনে খরচ করা তার প্রতি ৮৮ হাজার ডলার ছিল একজন সাধারণ মার্কিন নাগরিকের ১ ডলার খরচের সমান।
তাছাড়া, আবাসন খাতেও বিপুল অর্থ খরচ করেন বেজোস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ জমি মালিকদের একজন। তিনি এবং তার পরিবার ব্যক্তিগত নিবাস হিসেবে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচটি অতিকায় প্রাসাদসম বাড়ির মালিক।
ওয়াশিংটনের মেদিনা এলাকায় এমনই একটি ৫.৩ একরের পারিবারিক এস্টেট আছে বেজোসের। অ্যামাজনের সিয়াটল সদর দপ্তর থেকে যা খুব বেশি দূরেও নয়।
সিয়াটলের অতি-ধনীরা কোন স্বর্গে থাকেন, সরজমিনে তা দেখতে ২০১৭ সালে মেদিনা ভ্রমণ করেছিলেন বিজনেস ইনসাইডারের হ্যারিসন জ্যাকব।
প্রবেশের অনুমতি না থাকায় বাইরে থেকেই বেজোস এস্টেটের এক ঝলক দেখতে পান জ্যাকব। কিন্তু, উঁচু ঝোপঝাড়ের সারি আর সদর দরজার কারণে ভেতরটা সম্পর্কে খুব বেশি জানতে পারেননি তিনি।
ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসের কাছে স্পেনীয় নির্মাণশৈলীর একটি ম্যানসন কিনেছিলেন বেজোস। ২০০৭ সালে এ সম্পত্তি ক্রয়ে তিনি খরচ করেন দুই কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এক দশক পরে এই ম্যানসনের পাশেই আরেকটি ছোট বাড়ি কেনেন তিনি।
টেক্সাসের ভ্যান হর্নের কাছে আরেকটি র্যাঞ্চ কিনেছেন বেজোস। এটি তার মহাকাশ অভিযান কোম্পানি ব্লু স্পেস এক্সপ্লোরেশনের ঘাঁটি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
অতি-সম্প্রতি সাড়ে ১৬ কোটি ডলারে বেভারলি হিলসে আরেকটি ম্যানসন কিনেছেন বেজোস। ওয়ার্নার স্টেট নামক এ প্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন সম্প্রতি ক্রয়ের কথা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
অতি-ধনীদের অনেকেই উচ্চদরের গাড়ি চালাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। বেজোসের পছন্দ কিন্তু নান্দনিক ধাঁচের। ২০১৩ সালেও তিনি একটি পুরোনো মডেলের হোন্ডা একর্ড চালিয়েই অফিস করতেন।
আকাশপথে যাত্রায় অবশ্য ব্যয় করতে কার্পন্য নেই বেজোসের। তার একটি সাড়ে ছয় কোটি ডলারের গালফস্ট্রিম G650ER মডেলের প্রাইভেট জেট বিমান আছে।
সম্পদ বিলিয়ে দিতেও জেফ বেজোস কৃপণতা করেন না। তার মতো অন্য অতিধনী বিল গেটস এবং ওয়ারেন বাফেটের মতো তিনিও তার সিংহভাগ সম্পদ দাতব্যকাজে দান করার অঙ্গিকার করেছেন।