নওগাঁয় হাজার কোটি টাকার টুপি রপ্তানির সম্ভাবনা
নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলায় হাতের সেলাইয়ে তৈরি হয় বিশেষ টুপি। আর এসব টুপি চলে যায় মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে। বছরের দুই ঈদে এই টুপির চাহিদা থাকে বেশি। সারা বছর টুপি সেলাইয়ের টুকটাক কাজ হলেও রমজান এবং ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সুঁই-সুতা দিয়ে তৈরি চমৎকার এসব টুপির চাহিদাও ব্যাপক। এই টুপির কারিগর মূলত গ্রামীণ নারীরা। টুপি সেলাইয়ের কাজ করে এখন অনেকের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। সংসারে কাজের পাশাপাশি টুপি সেলাইয়ের কাজকেই তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানান বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার টুপি রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা যায়, গত একযুগ আগে ফেনী জেলা থেকে প্রথম জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় ব্যবসায়ীরা টুপি নিয়ে আসে। তাই বলা যায় মহাদেবপুর উপজেলায় এ টুপির উৎপত্তি। এরপর নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে টুপি সেলাইয়ের কাজ শুরু হয়। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন জেলার ১১টি উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এ টুপি তৈরির কাজ। টুপির সাথে প্রায় ২০০ জন ব্যবসায়ী জড়িত। আর টুপি তৈরির সাথে প্রায় ৫০ হাজার নারী কারিগর জড়িত। এ কাজ করে গ্রামীণ নারীরা বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছে।
এক থান কাপড় থেকে প্রকারভেদে ৯০ থেকে ১০০টি টুপি তৈরি হয়। এরপর সাইজ করা টুপির কাপড়ে নকশা করা পলিথিন রেখে তেল ও ব্লু (নীল রং) দিয়ে ছাপ দেয়া হয়। বিভিন্ন ফুলের নকশা করা হয়। ছাপ দেওয়া নকশার ওপর মেশিন দিয়ে সেলাই করা হয়। এরপর এ টুপিটি বিভিন্ন কারিগরদের কাছে হাতের কাজ করতে দেওয়া হয়। নকশার ওপর সুঁই এর সাহায্যে বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে ফুল তোলা হয়। সুঁইয়ের ফোঁড়ে নান্দনিক নকশা ফুটে উঠে একেকটা কাপড়ে। বিশেষ কায়দায় সেলাই ও ভাঁজ করে এই কাপড় দিয়ে বানানো হয় টুপি। সংসারে কাজের পাশাপাশি সারা বছরই টুপি তৈরি হয়। পড়াশুনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও টুপি তৈরির কাজ করে থাকে।
বিশেষ ধরনের এ টুপিতে মূলত চার ধরনের নকশা- চেইন, বোতাম, দানা ও মাছের কাঁটা সেলাই থাকে। প্রতিটি টুপিতে থাকে আলাদা নকশা। কয়েক হাত বদল হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ টুপি তৈরি হয়। টুপি ব্যবসায়ীরা টুপি তৈরির সব ধরনের উপকরণ কারিগরদের নিকট সরবরাহ করে। কারিগররা প্রকারভেদে টুপির মজুরি পেয়ে থাকেন ২০০ টাকা থেকে ১,৫০০ টাকা। সময় লাগে ৩ দিন থেকে এক মাস। টুপির মধ্যে বেশি সময় ও পরিশ্রম হয় দানা সেলাই। এ টুপি তৈরিতে খরচ পড়ে মজুরি ১,৫০০ টাকা, সুতা ১৩০ টাকা, বেল্ট ১৪০ টাকা এবং এজেন্ট বা মাঠ কর্মী ২০ টাকা।
এছাড়া গিট সেলাই-এর টুপিতে মজুরি পড়ে ২০০ টাকা, বেল্ট ১১০ টাকা, সুতা ১৫টাকা এবং এজেন্ট বা মাঠ কর্মী ২০ টাকা। এই টুপি ৩০০-৪০০ টাকা লাভে বিক্রি হয়ে থাকে।
মহাদেবপুর উপজেলার মধুবন, কুঞ্জবন, খাজুর, রনাইল, খোসালপুর, ভালাইন, সুলতানপুর, উত্তরগ্রাম, শিবগঞ্জ, গোয়ালবাড়ি, তাতারপুর গ্রাম, নওগাঁ সদর উপজেলার দূর্গাপুর, বাচারি গ্রাম, বর্ষাইল, পাহাড়পুর, কীর্তিপুরসহ জেলার ১১টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারীরা এই বিশেষ ধরনের টুপি তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
এটি বিশেষ এক ধরনের টুপি, যা ওমানের জাতীয় টুপি নামে পরিচিত। বর্তমানে পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যেরর বিভিন্ন দেশে এখানকার তৈরি টুপি যাচ্ছে। টুপি তৈরির পর ঢাকার চকবাজার, বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে পাঠানো হয়। সেখানকার ব্যবসায়ীরা আবার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এসব রপ্তানি করেন।
টুপির প্রাথমিক কাজ করেন সেলাই মাস্টার ও প্রিন্টিং মাস্টার। তারা জানান, কাপড়ের থান থেকে টুপি মাপ মতো কাটার পর তাদের কাছে দেওয়া হয়। এরপর প্রাথমিক সেলাই ও বিভিন্ন প্রিন্ট (নকশা) করা হয়। প্রতি পিস সেলাই এর জন্য আড়াই টাকা এবং প্রিন্ট এর জন্য আড়াই টাকা মজুরি পান। প্রতিদিন তারা ৩০০-৩৫০ টি টুপির কাজ করতে পারেন।
মহাদেবপুর উপজেলার মধুবন গ্রামের গৃহবধু আরজিনা বেগম বলেন, বাবার বাড়ি উপজেলার পদ্মপুকুর গ্রামে। গত ১২ বছর আগে মধুবন গ্রামে বিয়ে হয়ে আসছি। বাবার বাড়ি থেকে হাতের এবং সেলাই মেশিনের কাজ শিখেছি। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে দেখছি প্রতিবেশীরা হাতে টুপি সেলাইয়ের কাজ করছে। তাদের দেখাদেখি গত ৮ বছর থেকে টুপিতে নকশার ওপর সেলাই মেশিনের সাহায্যে সেলাই করছি। প্রতিটি টুপি সেলাই করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। প্রতিটির মজুরি ২০ টাকা। সংসারের কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন ৫-৬ টা টুপির কাজ করতে পারি। এ গ্রামে তার মতো আরো ২০-২৫ জন নারী সেলাই মেশিন দিয়ে টুপি সেলাইয়ের কাজ করে বলে জানান তিনি।
কুঞ্জবন ঈদগাহ পাড়া গ্রামের গৃহবধু জুলেখা বেগম বলেন, টুপির প্রাথমিক কাজ প্রিন্টিং (নকশা) এর পর তার ওপর সেলাই মেশিন দিয়ে সেলাই করা হয়। দুই সেলাইয়ের মাঝ দিয়ে সুঁই দিয়ে মোটা সুতা ঢুকাতে হয়। প্রতি টুপিতে মজুরি পাওয়া যায় ১৫ টাকা। এভাবে সপ্তাহে প্রায় দুই হাজার টাকা আয় হয়। এছাড়া ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টুপি নিয়ে গ্রামের অনেক মেয়েদেরও দিয়ে থাকি। সেখান থেকেও বাড়তি কিছু টাকা আয় হয়।
একই গ্রামের গৃহবধু পারুল বেগম বলেন, তার স্বামী ট্রাকের শ্রমিক। বেশির ভাগ সময় সে বাহিরে থাকে। এক সময় সংসারের কাজ শেষে হাতে তেমন কাজ না থাকায় গল্প করে সময় চলে যেতো। গত ১০ বছর থেকে এলাকায় টুপির কাজ আসার পর গ্রামের নারীরা এ কাজে ব্যস্ত সময় পার করে। সংসারের কাজ শেষে এখন এ টুপি সেলাইয়ের কাজ করে বাড়তি আয় করছেন তারা। প্রতি মাসে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় হয়ে থাকে। যা দিয়ে স্বামী ও সংসারে সহযোগিতা করা হয়। সংসারেও এসেছে স্বচ্ছলতা। বসে বসে সময় নষ্ট না করে টুপি সেলাইয়ের কাজ করে আয় করা অনেকটা সহজ হয়েছে।
উপজেলার সরস্বতীপুর গ্রামের টুপি ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, প্রতিবেশি বড় ভাই ওসমান আলীর দেখাদেখি এ পেশার সাথে জড়িয়ে পড়ি। গত ১০ বছর থেকে টুপি ব্যবসা করছি। প্রায় ৫০০ জন নারী কারিগর টুপি সেলাইয়ের কাজ করে। টুপির কাজ সারা বছরই হয়ে থাকে। তবে ঈদুল ফিতরের তিনমাস আগ থেকে ঈদুল আজহা পর্যন্ত টুপির চাহিদা বেশি থাকায় কাজও বেশি হয়। কাজ শেষে স্থানীয় মহাজনদের কাছে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০টি টুপি বিক্রি করা হয়। প্রতি টুপিতে গড় হিসেবে ১০০ টাকা লাভে বিক্রি করে থাকি। মহাজনরা আবার সেসব টুপি ওমানে পাঠায়।
মহাদেবপুর উপজেলার টুপির বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন আদম উদ্দিন। বাড়ি উপজেলার মধুবন গ্রামে। তিনি বলেন, মুল পেশা কৃষি কাজ। পাশাপাশি গত ১২ বছর থেকে টুপির ব্যবসা করছি। আগে ফেনী ও নোয়াখালি জেলা থেকে টুপির কাপড়, সুতা ও নকশা করে নিয়ে আসতে হতো। ব্যাপক চাহিদা থাকা এখন উপজেলাতে টুপির উপকরণ পাওয়া যাচ্ছে। আমার অধীনে ১০ জন এজেন্ট কাজ করে। তারা বিভিন্ন গ্রামের নারী কারিগরদের টুপি দিয়ে কাজ শেষে নিয়ে আসে। তাদের অধীনে প্রায় ১ হাজার নারী কারিগর টুপি সেলাইয়ের কাজ করে। গিট, চেইন ও মাছের কাঁটা নকশা টুপি সেলাইয়ে সময় কম ও মজুরিও কম। এসব টুপি সেলাই করতে ৩-৭ দিন সময় লাগে এবং মজুরি ২০০-২৫০ টাকা। দানা টুপি সেলাইয়ে কমপক্ষে এক মাস সময় লাগে এবং মজুরি ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা।
তিনি বলেন, বিশেষ ধরনের এ টুপি ঈদুল ফিতরের তিনমাস আগ থেকে ঈদুল আজহা পর্যন্ত চাহিদা বেশি থাকায় কাজও বেশি হয়। এসব টুপি দেশের বাইরে চলে যায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে এর চাহিদা বেশি। নিজেই সে দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টুপি রপ্তানির কথা জানান তিনি।
প্রকারভেদে প্রতিটি টুপি ৮০০ টাকা থেকে ৩,৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখানে প্রায় ১৫০ জন টুপি ব্যবসায়ী আছে। এ বছর প্রায় এক হাজার কোটি টাকার টুপি রপ্তানির সম্ভবনা রয়েছে বলে জানান আদম উদ্দিন।