হাতে তৈরি টুপি বিক্রি করে স্বাবলম্বী লক্ষ্মীপুরের নারীরা, মাসে ৫ কোটি টাকার রপ্তানি
বাংলাদেশে টুপির বাজার বছরজুড়ে। কিন্ত দেশের উপকূল অঞ্চলের নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি বিশেষ একধরনের টুপি রপ্তানি হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের বহু দেশে। প্রতি মাসেই হাতের কাজের টুপি তৈরিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন হাত, বাড়ছে রপ্তানি। স্বচ্ছতা আসছে গ্রামের দরিদ্র নারীদের সংসারে। এসব তথ্য জানিয়েছেন টুপি তৈরির কারিগররা।
আর ব্যবসায়ীরা বলছে টুপি রপ্তানি করে দেশের আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৪৪৭.৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের টুপি রপ্তানি করে। রপ্তানি করা টুপির মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই বাংলাদেশি নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি নকশি টুপি। দেশের অন্তত ১৫টি জেলায় তেরি হয় এমন টুপি। টুপির বিভিন্ন পর্যায়ের কারিগর ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকার বাইরে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, নওগাঁ, বগুড়া, রংপুর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় নারী ও নকিশোরীদের হাতে তৈরি হয় বিশেষ এক টুপি। হাতে তৈরি এসব টুপি শতভাগ বিদেশে রপ্তানি হয়।
লক্ষ্মীপুর জেলার স্থানীয় কারিগর, টুপির এজেন্ট ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধির সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের চারটি উপজেলায় অন্তত দুই লাখ নারী ও কিশোরী নকশি টুপি তৈরি করে। লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৫ লাখ টুপি ব্যবসায়ীদের হাত হয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়। এতে কারিগর ও ব্যবসায়ীদের মাসে গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি আয় হয়। স্থানীয় প্রবাসীদের ভাষ্যে, 'মেইড ইন বাংলাদেশ' লেখা এসব টুপি নিয়ে পরছেন বিশ্বের বহুদেশের মুসলিমরা।
কোথায় রপ্তানি হয়
লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার বাজারের টুপি ব্যবসায়ী আশরাফ, জহির উদ্দিন এবং নুরনবী জানায়, হাতে তৈরি টুপির প্রধান ক্রেতা দেশ ওমান। এছাড়া সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, কাতার, মালয়েশিয়ায় টুপি রপ্তানি হয়।
হাতে বানানো টুপির এত চাহিদা কেন
দীর্ঘদিন ওমানে প্রবাসী ছিলেন সিরাজ উদ্দিন এবং সৌদি আরবে প্রবাসী রয়েছেন মোঃ কবির হোসেন। তারা জানান, বাংলাদেশি নারীদের হাতে সুঁইসুতার কাজের মান এবং চমৎকার ডিজাইনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমরা মেশিনে তৈরি টুপির পরিবর্তে হাতের নকশায় তৈরি টুপি বেশি কিনেন। সিরাজ জানায় ওমানের এমন কোন মার্কেট নেই যেখানে বাংলাদেশি টুপি পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে কবির জানান, মক্কাসহ সৌদি আরবের বড় বড় মার্কেটে বাংলাদেশি হাতে তৈরি টুপির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। হজ্বের সময় বিভিন্ন দেশের হাজীরা বাংলাদেশি নারীদের হাতে তৈরি টুপি ক্রয় করে থাকেন।
গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে টুপি তৈরি করছেন নারীরা
লক্ষ্মীপুরের দরিদ্রপ্রবণ উপজেলা কমলনগর, রামগতি, সদর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং রায়পুর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের চরাঞ্চলের নারী ও কিশোরীরা মূলত হাতে তৈরি টুপির প্রধান কারিগর। বর্তমানে অনেক সচ্ছল পরিবারের নারীরাও বাড়তি আয়ের জন্য টুপি তৈরি করছেন। কমলনগর ও রামগতির প্রায় ৮০ ভাগ বাড়িতে টুপি তৈরি হয়।
কমলনগর উপজেলার উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামের বিলাত আলী বাড়ির অন্তত ৩০ জন নারী হাতে তৈরি টুপির কারিগর। এ বাড়ির জেসমিন আক্তার (৩০) জানান, গত ১০ বছর যাবত সংসারের কাজের ফাঁকে টুপি বুনন করে মাসে গড়ে সাড়ে ৪ হাজার টাকা আয় হচ্ছে তার। ২৫ বয়সী ফাতেমা বলেন, টুপি তৈরির আয় দিয়ে তিনি স্বামীকে সংসারের জন্য সাহায্য করছেন।
হতদরিদ্র নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে টুপি বুনন করে পরিবারের বাড়তি রোজগার করছেন। লাভজনক হওয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি টুপি বুননের কাজে নেমে পড়েছেন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরাও।
ব্যবসায়ী আশরাফ জানান, রামগতি উপজেলা হচ্ছে টুপি তৈরির প্রধান এলাকা। রামগতিতে ১ লাখের বেশি নারী প্রতি মাসে প্রায় ৩ লাখ টুপি তৈরি করেন। রামগতির চর আলেকজান্ডার, চর সেকান্তর, শেখের কেল্লা গুচ্ছগ্রাম, রামগতি, বাজার এলাকা, চররমিজ, চরকলাকোপা এলাকার প্রত্যেক নারী টুপি তৈরি করে।
শুধু মুসিলম নারীরা নয়, সনাতন ধর্মের নারীরাও জড়িত হচ্ছেন। রামগতি পৌরসভার সাহাপাড়া, চরহাছান হোসেন ও পন্ডিত পাড়াতে এ কাজের সাথে জড়িয়ে থাকা প্রায় শতাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী প্রতিদিন বুনে চলছেন টুপি।
ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যে জানা যায়, কমলনগরের ৫০-৬০ হাজার নারী ও কিশোরী প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখের বেশি টুপি তৈরি করে। কমলনগর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের কালকিনি ইউনিয়নে মতিরহাট কলোনী, চর লরেঞ্চ, চরফলকন, চর জাঙ্গালিয়া, চরকাদিরার চরঠিকাসহ সবগুলো এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই টুপি তৈরি হয়।
আলেকজান্ডার বাজারের টুুপি ক্রেতা কারিমুল হক বিপ্লব জানায়, প্রতি মাসে তিনি প্রায় ৫ হাজার টুপি ক্রয় করেন। একই বাজারে অন্তত ২০০ জন ক্রেতা টুপি ক্রয় করেন। প্রত্যেকে মাসে ২-৫ হাজার টুপি ক্রয় করেন। কমলনগরে ২০-২৫ জন, সদর উপজেলায় ২০ জন এবং রায়পুরে ১৫-২০ জন টুপি ক্রেতা রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানায় লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে মাসে প্রায় ৫ লাখ টুপি রপ্তানি হয়। যেগুলো তৈরিতে প্রায় ৫ কোটি টাকা মজুরি পান কারিগর ও স্থানীয় এজেন্ট এবং ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয়রা জানায়, আশির দশকে ফেনী জেলার প্রবাসী কয়েকজন বাসিন্দার হাত ধরে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে টুপি তৈরি শুরু হয়। এখন পুরো জেলায় ছড়িয়ে পুড়েছে। শুধু লক্ষ্মীপুরেই না, দেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে টুপির কারিগর বেশি।
স্থানীয় কয়েকজন নারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, টুপি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় জাপানি কাপড় ও ভারতীয় সুতা। কাপড় ও সুতা কিনে নকশার নমুনা দিয়ে গ্রামের নারীদের কাজ বুঝিয়ে দেয় ব্যবসায়ী এজেন্টরা। নকশা করা টুপি তৈরিতে ১১টি ধাপ রয়েছে। কাপড় কাটা, ইস্ত্রি করা, নকশা আঁকার পর সুঁই-সুতার বুননে তা ফুটিয়ে তোলা। নকশা তোলা শেষে আবার কাটিং করে ধোলাই ও ইস্ত্রি করা হয়। লাগানো হয় টুপির মাঝখানের অংশ (টপ)। যন্ত্রে আঁকা নকশা ফুটে ওঠে সুঁইসুতার বুননে। পরে কাপড়গুলো সেলাই করে তৈরি হয় টুপি। নারীরা মূলত সুঁই-সুতার বুনন করে।
কারিগর কোহিনুর, জেসমিন, মুন্নী বেগম জানায়, টুপির কাপড়, সুতা এবং ডিজাইনের মানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি টুপি তৈরির জন্য নারী কারিগররা ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা মজুরি পান। একেকটি টুপি তৈরি করতে কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ দিন সময় লাগে।
কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোঃ নিজাম উদ্দিন জানান, তার ইউনিয়নেই প্রায় ১০-১৫ হাজার পরিবার দৈনন্দিন সংসারের কাজের ফাঁকে নকশি টুপি বুনন করে বাড়তি রোজগার করছে। এ কারিগরদের জন্য জেলা ভিত্তিক বাজার গড়ে তুলতে পারলে কারিগররা আরো বেশি পারিশ্রমিক পাবে। পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে।