মোবাইল যেভাবে ‘ধ্বংস করল’ বোর্ড গেমের কারিগরদের
কাদের লুডু ফ্যাক্টরির চার কর্মী পুরান ঢাকার ছোট কাটরার একটা শতবর্ষী ভবনের তিন তলায় বসে নিঃশব্দে কাজ করছিলেন।
ছোট কাটরার গোলকধাঁধার মতো রাস্তাঘাট পেরিয়ে এ লুডু ফ্যাক্টরিটি খুঁজে বের করতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। গলির ভেতরের এ পুরোনো ভবনে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে চলছে দোকানটি।
ভবনের সিঁড়িগুলো কাঠের। জীর্ণদশা দেখেই বয়স নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ওঠার সময় একবার মনে হলো, আমাদের ভর নিতে পারবে তো। আশপাশ থেকে নাকে আসা গন্ধে বোঝা গেল, ইঁদুরের দিব্যি আশ্রয়স্থল এ ভবন।
গত ২৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন কাদের লুডু'র ব্যবস্থাপক রুহুল আমিন। কোম্পানির সোনালি দিনগুলো নিজের চোখে দেখা তার। এখন কোনোক্রমে ক্ষয়ে আসা ব্যবসায়টাকে ধরে রেখেছেন।
'কোনো এককালে এখানে দিন-রাত মিলিয়ে ২৫ জনের বেশি মানুষ কাজ করত। এখন আমিসহ কেবল চারজন আছি। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও আমরা দিনে ২,৫০০'র বেশি লুডু বোর্ড সরবরাহ করতাম। এখন দৈনিক ৫০০টাও বানাই না,' লুডু বোর্ডে মাখানোর জন্য আঠা বানাতে বানাতে বললেন রুহুল।
'মোবাইল গেমগুলো আসার পর বেশিরভাগ লুডু কারখানার ব্যবসায় গুটিয়ে গেছে। অতীতে আমাদের কর্মীরা ওভারটাইম করতেন, রাতে কাজ করতেন। আর এখন দুবেলা আহার জোটানোর জন্য এটার পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবেও বাইরে কাজ করতে হয়,' তিনি বলেন।
বাংলাদেশে বোর্ড গেম হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রিয় লুডু। অবসরে লুডু খেলে সময় কাটাতে পছন্দ করেন অনেকে। অ্যাপভিত্তিক লুডু গেমগুলো জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকেই একসময়ে ভালোবাসার এ ঐতিহ্যবাহী বোর্ড লুডুগুলো কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে।
এ খেলা ডিজিটাল মাধ্যমে চলে আসার কারণে চিরায়ত লুডু বোর্ড নির্মাতারা এখন তাদের জীবিকা হারাচ্ছেন। ক্যারম, দাবা ইত্যাদি বোর্ড গেমগুলোর পরিস্থিতিও একই।
'গত পাঁচ বছরে ব্যবসায় ক্রমশ খারাপ হয়েছে। মানুৃষের ফোনে গেমগুলো আসার পর থেকেই ব্যবসায় নিয়ে ভুগছি আমরা,' বলেন রুহুল।
কাদের লুডু'র আরেক কর্মী ইমরান হোসেন জানান, অতীতে হাজারিবাগ ও কমলবাগ এলাকায় অনেক লুডু ফ্যাক্টরি ছিল। কিন্তু সেগুলো আর এখন ব্যবসায় নেই। বেশিরভাগ লুডুর ব্যবসায় ছেড়ে প্লাস্টিকের ব্যবসায় ধরেছে।
'এ গলির মাথায় একটা কারখানা ছিল। সেটাও উঠে গেছে। এমন অনেককে চিনি যারা লুডুর ব্যবসায় মার খেয়ে এখন রিকশাচালক, দৈনিক চুক্তির শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। এসব ঘটেছে বিগত পাঁচ বছরে,' বলেন ইমরান।
এ কারখানায় ছোটবেলা থেকেই কাজ করছেন শামিম। প্রায় ২০ বছর হয়ে গেছে তার এখানে।
'আগে এ লাইনে টাকা ছিল। যাত্রী না থাকলে রিকশাওয়ালারা বোর্ড নিয়ে বসে পড়ে গেম খেলত। এটা জনপ্রিয় ছিল। দাবা বা ক্যারম অনেকেই বুঝত না, কিন্তু লুডু যে কেউ খেলতে পারত,' বলের শামিম।
তার মতে ক্যারম আর দাবার ব্যবসায়ীরাও কষ্টে আছেন তবে 'আমাদের মতো না, ওদের বাজার সবসময় ছোটই ছিল।'
শামিম আরও বলেন, 'এখন সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেও দিনে ৪০০ টাকা আয় করতেও কষ্ট হয়ে যায়। আগে যখন বেশি কাজ ছিল, তখন দিনশেষে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় হতো। তখন ৬০০ টাকারও অনেক মূল্য ছিল। জিনিসপত্রের দাম কম ছিল।'
ছোট হয়ে আসা এ ব্যবসায়র ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে কর্মীদের। অনেককেই 'রাতের বেলা ট্রাকে মাল তোলার মতো' দ্বিতীয় কাজ করতে হচ্ছে বলে জানান শামিম। তার মতে এখন বেতন বাড়ানোর কথা বলেও লাভ নেই।
'বেতন কেমনে বাড়বে? বিক্রিইতো হয় না। এ ব্যবসায়র ঘুরে দাঁড়ানোর আর কোনো পথ নাই। সামনে কী করব বুঝতে পারছি না,' দুঃখ করে বলেন বেচারা।
ভুগছেন আগা সাদেক লেনের ক্যারম কারিগরেরাও
পুরান ঢাকার আগা সাদেক লেনে আমাদের আলাপ হয় অর্ধডজেন ক্যারম কারিগরের সঙ্গে। তারা সবাই জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের ব্যবসায় মারাত্মকহারে কমে গিয়েছে।
'ডিজিটাল গেমিং-এর একটা প্রভাব আছে এখানে। আমাদের বিক্রি-বাট্টা এখন মৌসুমি হয়ে গেছে পুরোদস্তুর। গ্রীষ্মকালে কিছু বিক্রি হলেও শীতে তেমন বিক্রি থাকে না,' বলেন ইব্রাহিম নামক একজন কারখানার মালিক।
এ লেনে একসময় ৩০টির বেশি কারখানা ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা অর্ধেকের কমে নেমে এসেছে। কেন?
'কারণ দরকারি জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আমাদের বিক্রয়মূল্য একই আছে। যেমন আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে ছোট একটা বোর্ড আমরা ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি করতাম। এখনো এ দামেই করছি।
'ধরের এই বোর্ডটা (৫৬" * ৫৬") বানাতে আমার ৪,২০০ টাকা খরচ হলো। কিন্তু তারপরও আমাকে এটা ৪,০০০ টাকায়ই বিক্রি করতে হবে, কারণ ক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে নেবে না,' ইব্রাহিম বলেন।
'অনেকের মতো হয়তো আমাকেও এ ব্যবসায়র পথ ছাড়তে হবে। অন্য কিছু শুরু করতে হবে। এই যেমন এ ডিসেম্বর মাসে আমি এখনো একটা বোর্ডও বিক্রি করতে পারিনি। নভেম্বরে ছোট বোর্ডগুলো ৫০টার কম বিক্রি হয়েছিল। আগে আমার পাঁচ থেকে সাত জনের মতো কর্মী ছিল। এখন কেবল আমি কাজ করছি,' বলেন তিনি।
এ লেনেরই আরেক দোকান বাশার ক্যারম। এ কারখানার প্রধান কারিগর জামাল এখানে ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন। 'আগে মাসে ৩০০ বোর্ড বেচা হতো। এ কারখানার বয়স প্রায় ২৫ বছর। অতীতে ছোট বোর্ডগুলো দিনে ৫০টাও বেচা যেত,' জামাল বলেন।
'আর এখন মাসে ৫০টাও বিক্রি হয় না। পাঁচ-সাত বছর আগে থেকে এমন পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। ধরেন, একটা কারখানার ভাড়া ১৫,০০০ টাকা। এখন মালিক কি কর্মীদের বেতন দেবে, ভাড়া দেবে, নাকি নিজে আয় করবে?' প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ক্যারম কারখানার কিছু কর্মী অবশ্য লুডু ব্যবসায়ীদের তুলনায় কিছুটা আশাবাদী। তাদের প্রত্যাশা কোনো একদিন তাদের সুদিন ফিরে আসবে।
'ক্যারম খেলার বাস্তব অনুভূতি মোবাইলে পুরোটা পাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তবে খেলতে অনেক বেশি মজা। তাই ব্যবসায় ধাক্কা লাগলেও মোবাইল গেম আমাদের ব্যবসায়কে পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দিতে পারবে না। আমরা টিকে যাব,' বাশার ক্যারমের এক কর্মী এমনটাই বললেন।