তাপদাহ আপনাকে অসুস্থ করে যেভাবে জীবন বিপন্নও করতে পারে
গত বছর তীব্র দাবদাহে দেখা দেয় বিশ্বজুড়ে। ইউরোপেও চলে তার তাণ্ডব। এসময় স্পেনের সেভিল শহরের কর্মকর্তারা এক তাপপ্রবাহের নাম দেন - জো। এ ধরনের নামকরণ সাধারণত ঘূর্ণিঝড় বা মারাত্মক দাবানলকেই দেওয়া হয়। কিন্তু, সেসব দুর্যোগের মতোনই তীব্র তাপপ্রবাহটিকে চিহ্নিত করেন স্পেনীয় কর্মকর্তারা। তিনদিনব্যাপী এই তাপদাহের আগে থেকেই সতর্কতার অংশ হিসেবে তারা পানিশুন্যতা, প্রচণ্ড গরমে শারীরিক ক্লান্তি, হিট স্ট্রোক ও মৃত্যু ঠেকাতে শহরবাসীকে নানান পরামর্শও দেন।
চরম তাপপ্রবাহের যে মারাত্মক প্রভাব মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে পড়ে, তা মোকাবিলার অংশ হিসেবেই সাম্প্রতিককালে চরম তাপপ্রবাহের নামকরণ করা হচ্ছে। কারণ, প্রতিবছর অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটায় অসহনীয় গরম। যেমন গত বছরের প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে চারদিনের প্রচণ্ড দাবদাহে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে।
এই বাস্তবতায়, নামকরণ করা হলে জনসাধারণ সহজে তাপপ্রবাহের বিপদ সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারে। ফলে তাদের অসতর্ক হওয়ার প্রবণতাও কমে আসে। তাপপ্রবাহ চলাকালে ঘরের বাইরে থাকা বা শারীরিক পরিশ্রম করার ক্ষেত্রে তারা সতর্ক থাকতে পারেন।
বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলেন অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আর্শট-রকফেলার) এর এক্সট্রিম হিট ইনিশিয়েটিভের পরিচালক কুর্ট শিকম্যান। আর্শট-রকফেলার ঢাকাসহ বিশ্বের আটটি শহরে চরম তাপমাত্রার প্রভাব প্রশমনে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ করেছে।
কুর্ট শিকম্যানের মতে, "ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডোর পর ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে গণমাধ্যমের ক্যামেরা। ফলে সাধারণ মানুষের অজানা থাকে না এসব দুর্যোগের বিপদ। কিন্তু, চরম তাপের বেশিরভাগ ক্ষতিই গোপন, বা চাক্ষুষ করা যায় না।"
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে তাপদাহের ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন তাপপ্রবাহ বেড়েই চলেছে। স্থায়িত্বও দীর্ঘ হচ্ছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় চলতি বছর গ্রীষ্মের আগেই দেখা দেয় তাপদাহ। বাংলাদেশও এসময় মাঝারি তাপদাহের কবলে পড়ে। এতে চরম ভোগান্তি হয়েছে জনমানুষের।
উন্নত দেশও জলবায়ু পরিবর্তনের এই চরম সংকটের মুখে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে চলতি গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গড় তাপমাত্রার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। দেশটির মিয়ামি- ডেড কাউন্টির মেয়র ড্যানিয়েলা লেভিন কাভা বলেন, "চরম তাপদাহের বিষয়কে আরও বেশি বেশি সচেতন করাটা আমাদের জলবায়ু অদম্যতা কৌশলের অংশ।"
অর্থাৎ, দম বন্ধ করা গরমকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। গরমের প্রকট কমাতে সবুজ ও জলাশয় এলাকা বৃদ্ধির উদ্যোগ থাকতে হবে। নগর পরিকল্পনায় গুরুত্ব দিতে হবে তাপ প্রশমন। দক্ষিণ এশিয়া, বা আমাদের এই অঞ্চলের জন্য তা আরও অপরিসীম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা দেওয়া চরম তাপদাহ– বার বার দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ৩০ গুণ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি হিসাব অনুসারে, বছরে ৭০০ আমেরিকান চরম তাপমাত্রার প্রভাবে মারা যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আনুষ্ঠানিক তথ্যে কমই রয়েছে মৃত্যুহার, প্রকৃতপক্ষে যা আরও বেশি। গরমের প্রভাবে অনেক মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। অ্যাজমা ও কিডনি রোগ আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। তাতেও বহু মানুষের প্রাণ যায়। এসব ঘটনাকে সরাসরি তাপদাহ-জনিত মৃত্যু হিসেবে গণনা করা হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। উন্নয়নশীল দেশে গণনার বাইরে থাকা এ মৃত্যুহার যে আরও বেশি, তা বলাইবাহুল্য।
মিয়ামির চিফ হিট অফিসার জেন গিলবার্ট বলেন, শুধু রোগব্যাধি নয়, বিভিন্ন দুর্ঘটনার সাথেও খরতাপের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। যেমন প্রচণ্ড তাপে সংজ্ঞা হারিয়ে নির্মাণাধীন ভবন থেকে নিচে পড়ে যেতে পারেন কোনো শ্রমিক। বিশ্বের তাপমাত্রা যত বাড়বে- তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে এধরনের দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা।
তাপদাহ যেভাবে আমাদের অসুস্থ করে
দেহে পানি শূন্যতা, মাংশপেশিতে টান ধরা, প্রচণ্ড ক্লান্তি বা অসারভাব, হিট স্ট্রোক – এসবই সরাসরি খরতাপের শারীরিক প্রভাব। গত বছরের এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানানো হয়, কোনো অঞ্চলের স্বাভাবিক যে স্থানীয় তাপমাত্রা – বাতাসের তাপমাত্রা তার চেয়ে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়লে, ওই এলাকাবাসীর তাপজনিত অসুস্থতার সংখ্যা ১৮ শতাংশ বাড়বে।
সাধারণত যেসব শারীরিক সমস্যা তেমন গুরুতর নয়, সেগুলোও বাজে রূপ নিতে পারে দাবদাহের সময়। এসময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মূত্রনালীর সংক্রমণ ও কিডনিতে পাথর হয়েছে এমন রোগীর আগমন বেড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তাত্ত্বিক ক্রেইগ এ. অ্যান্ডারসন বলেন, 'মানসিক স্বাস্থ্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন অবসাদ ও আত্মহত্যার সাথে উষ্ণতর তাপমাত্রার যোগসূত্র আছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে যা জেনেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানান, তাপমাত্রা বেশি থাকলে হাসপাতালে আসা সিজোফ্রেনিয়া ও উদ্বেগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ে।
অ্যান্ডারসন তার গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন যে, আগ্রাসন ও সহিংসতার মনোভাবকেও বাড়ায় উচ্চ তাপমাত্রা। গরমের কারণে মানুষের সহজে বিরক্তিভাব চলে আসাটাই হয়তো এর অন্যতম কারণ। তবে এর সাথে জৈবিক সংযোগ আছে বলে মনে করেন তিনি। যেমন অপেক্ষাকৃত উষ্ণ শরীরে অ্যাড্রিনালিন-সহ অন্যান্য জৈব রাসায়নিকের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে মানুষ অধৈর্য ও আগ্রাসী আচরণ করতে পারে।
তাপের কারণে মানুষের ঝগড়ার মনোভাবও বাড়ে। বিশ্বব্যাপী ৬০০ কোটি টুইট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুর্বিষহ গরমের সময়ে ব্যবহারকারীদের নেতিবাচক কমেন্টের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়।
এতকিছুর পরও বেশিরভাগ মানুষ গরমের ঝুঁকিকে যথেষ্ট আমল দেন না। গ্রিসে এক সমীক্ষার সময় এতে অংশগ্রহণকারীদের জলবায়ু-জনিত সবচেয়ে দুর্যোগগুলোকে ভয়াবহতা অনুসারে পর্যায়ক্রমে র্যাঙ্কিং করতে বলেন গবেষকরা। দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষ প্রথমে ভূমিকম্প, দাবানল, বন্যা বা প্রচণ্ড শীতের কথা উল্লেখ করেছে। আর সবার শেষে বলেছে তাপদাহের কথা। স্পেনের সেভিলের সেই দাবদাহ শুরু হওয়ার আগে একটি জরিপ চালানো হয়। এতে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ মানুষই জানায়, তাপপ্রবাহ নিয়ে তারা বিশেষ চিন্তিত নয়।
এই বাস্তবতায়, তাপদাহ মোকাবিলায় – এগুলোর নামকরণ এবং গরমের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে র্যাঙ্কিয়ের মতো উদ্যোগগুলো চলছে।
তাপপ্রবাহের র্যাঙ্কিং
তীব্র, মাঝারি বা মৃদু – বিদ্যমান এসব সংজ্ঞা দিয়ে তাপপ্রবাহের যেসব ঝুঁকি রয়েছে – তা পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। তাই উন্নত অনেক দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া দপ্তর – তাপমাত্রা ও বাতাসের আদ্রতার ভিত্তিতে তাপসারণী তৈরি করে। তবে এটিও নিখুঁত নয়। যেমন মিয়ামির ক্ষেত্রে দেখা যায়, আবহাওয়া দপ্তর যেসময় উচ্চ তাপসারণী প্রকাশ করে, তাপজনিত মৃত্যুগুলো তখন ঘটে না। এই অবস্থায় মিয়ামি-ডেড কাউন্টির কর্মকর্তারা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে একটি সঠিক তাপসারণী তৈরির কাজ করছেন।
শিকম্যান জানান, সারণী তৈরির ক্ষেত্রে উচ্চ তাপ ও আদ্রতার পরিমাণ ছাড়াও অন্যান্য প্রভাবকগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, দিনে যেমনই হোক, রাতেও যখন দুর্বিষহ গরম কমার নাম নেয় না, তখন শরীর ঠাণ্ডা হতে পারে না। ফলে রাত পোহালেই গরম আরও অসহ্য হয়ে ওঠে। "তাই জনস্বাস্থ্যের সবচেয়ে বেশি অবনতি ঘটে যখন রাতের তাপমাত্রাও উচ্চ থাকে, দিনেরটা নয়।"
আর্শট-রকফেলার পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে তাপপ্রবাহকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করার লক্ষ্য নিয়েছে। যেমন স্পেনের সেভিলে দৈনিক গড় তাপমাত্রা (রাতেরটা-সহ) যখন হঠাৎ করে বেড়ে যায়, তখন আগামী তিন-চারদিনের জন্য উচ্চ তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। আগের সপ্তাহগুলোয় তাপমাত্রা কতোটা ছিল, সে অনুসারে মানুষ কতোটা গরম সহ্য করতে পারবে– বিবেচনায় থাকে সেই দিকটিও। এসব মানদণ্ডের সাথে স্থানীয় আবহাওয়ার তথ্য এবং গত ২৫ বছরের গ্রীষ্মকালীন মৃত্যুহারকেও হিসাব করা হয়, যাতে যথাযথ জনস্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করা যায়। এই অনুযায়ী, চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির তাপমাত্রাকে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে গণ্য করা হয়। এজন্য তাদের নামকরণও করা হয়। যেমনটা করা হয় গত বছরের জুলাই মাসে।
সেভিল শহরের উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে দেখা গেছে, তাপপ্রবাহের বিপদকে দৃশ্যমান করে তুললে তার ভালো ফল পাওয়া যায়। নগর কর্তৃপক্ষের অপ্রকাশিত গবেষণার তথ্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পেয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে যেসব ব্যক্তি তাপপ্রবাহের বিষয়ে প্রচারণাগুলো দেখেছেন, তাদের মধ্যে বাড়িতে অবস্থান করা, বা বাড়ি থেকে ভার্চুয়াল ব্যবস্থায় অফিসের কাজ করার ঘটনা ছিল বেশি। শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণে তারা বেশি পানি পান করেছেন, যারা এসব প্রচারণা দেখেননি তাদের তুলনায়। এছাড়া, সচেতন ব্যক্তিদের ১৫ শতাংশই এখন মনে করেন, তাপ সতর্কতা তাদের আচরণ পরিবর্তনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।