রাস্তা থেকে মাঠে: পথশিশুদের স্বপ্ন বোনার এক স্পোর্টস অ্যাকাডেমি!
পায়ের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল সবাই। দুই পায়ে বুট আছে ঠিকই, কিন্তু দুটোই যে একই পায়ের! ডান পায়ের জন্য তৈরি করা একই মাপের একই বুট পরে গোলাপ যখন বঙ্গবন্ধু ফুটবল স্টেডিয়ামের পল্টন আউটার মাঠে ট্রেনিংয়ের জন্য হাজির হলো, তখন তার আগ্রহের কাছে হার মানলো সবকিছু। ভিক্ষা করে আয় করা দশ টাকার বিনিময়ে গুলিস্তান স্পোর্টস মার্কেটের এক দোকান থেকে পাওয়া বুটজোড়ার ওপরে চাপলো স্ট্রিট চিলড্রেন স্পোর্টস অ্যাকাডেমির ঢলঢলে সবুজ জার্সি।
খুব বেশি বয়স হয়নি গোলাপের। মাত্র ৮ বছর। অন্য অনেক পথশিশুর মতো তারও শৈশবের দিনগুলো কাটছে গুলিস্তানের ধুলোভর্তি রাস্তায়। পরিবারে বাবা নেই, মায়ের ভিক্ষার আয়ে পেট চলে চার ভাই-বোনের। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া-দাওয়া, সমবয়সীদের সাথে দৌড়ে বেড়ানো, খুনসুটি-ধাক্কাধাক্কি, বিকালে স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা পথের ইশকুলে হালকা পড়াশোনা থেকে শুরু করে রাতের ঘুম, সবকিছু হয় গুলিস্তানের রাস্তার ওপরেই।
দোমড়ানো পুরনো ফুটবল কিংবা ফেলে দেওয়া কাপড় মুড়িয়েই ফুটপাথ আর অলি-গলির ভেতরে গোলের উৎসব চালাতো গোলাপসহ অন্যরা। তাই যখন পথের ইশকুল তাদের স্পোর্টস অ্যাকাডেমি প্রকল্পে ফুটবল খেলার সুযোগের কথা জানায়, ভর্তি হতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি তারা। কেবল ফুটবল খেলার আগ্রহেই হাতিরঝিল থেকে পায়ে হেঁটে গুলিস্তানে যাওয়া-আসা শুরু করে জিসান নামের আরেক পথশিশু। খেলার মাধ্যমে শুরু হয় নতুন স্বপ্নের বীজবোনা।
পথে পথে পথের ইশকুল
পথশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০১৫ সাল থেকে কাজ শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পথের ইশকুল। ছোট পরিসরে কাজ শুরু করলেও লক্ষ্য ছিল পথশিশুদের ব্যক্তিগতভাবে জীবনমানে উন্নয়ন ঘটানোর। গত কয়েক বছরে রোটারি ক্লাব, লায়ন্স ক্লাবসহ নানা সংগঠনের সাথে একযোগে কাজ করেছে তারা; সীমিত সম্পদ কিন্তু লেগে থাকা মনোভাব নিয়ে এখনো পর্যন্ত কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে ২১ জন পথশিশুর।
বই-খাতা ছাড়াই চক-ব্ল্যাকবোর্ড আর ভিন্ন ধরনের উপস্থাপনা ও পথশিশুদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের অ-প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে পথের ইশকুল। সপ্তাহে ৬ দিনই গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাশে পরিচালনা করা হয় নিয়মিত ক্লাস। একইসাথে নিয়মিত একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়, যার অর্থ আসে স্বেচ্ছাসেবীদের পকেট আর ব্যক্তিগত দান থেকে।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানান সংস্থাটির প্রধান সাকির ইব্রাহিম মাটি। "পথশিশুদের জীবন অভিজ্ঞতা আর পরিবেশ আলাদা হওয়ায় বদ্ধ ক্লাসরুমের বই-খাতা দিয়ে তাদেরকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। এগুলো তাদের কাছে খুবই একঘেয়ে। তাই চক-ব্ল্যাকবোর্ড, ভিন্ন ধরনের উপস্থাপনা আর তাদের অংশগ্রহণে ইনফরমাল এজুকেশনের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু অনেকসময় এতেও তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ এর তুলনায় মাদক আর অপরাধের জীবন আরও আকর্ষণীয়।"
তাদের আগ্রহ কোন দিকে সেটি খেয়াল করেই স্পোর্টস অ্যাকাডেমি খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে পথের ইশকুল। স্পোর্টস অ্যাকাডেমিতে ঢোকার সুযোগ হিসেবে শর্ত দেওয়া হয়: কোনো ধরনের মাদক গ্রহণ করা যাবে না, কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়া যাবে না এবং নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে।
মাত্র দুই মাসেই স্পোর্টস অ্যাকাডেমির শিশুদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেখানে আগে নিয়মিত ক্লাস করানোর জন্য তাদেরকে খুঁজে বের করতে হতো, এখন খেলার জন্যই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জড়ো হয়ে যায় তারা। একইসাথে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ বেড়েছে, বেড়েছে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগও। সাথে মাদক গ্রহণ কিংবা অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কেও মনিটরিং করা হয়।
স্পোর্টস অ্যাকাডেমির অন্দরে
পথের ইশকুলের 'বাংলাদেশ স্ট্রিট চিলড্রেন স্পোর্টস অ্যাকাডেমি'র পরিকল্পনাটি খানিকটা দীর্ঘমেয়াদী এবং সুদূরপ্রসারীও বটে। তাদের প্রথম উদ্যোগ ছেলেদের ফুটবল। এ বছরেই মেয়ে পথশিশুদের জন্য সেলফ ডিফেন্স প্রকল্প চালু করবে তারা। এছাড়াও ভবিষ্যতে ক্রিকেট বা কাবাডির মতো খেলা যুক্ত করার পরিকল্পনাও আছে তাদের।
ফুটবলের প্রথম কোহোর্টের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের সময়কাল ধরা হয়েছে দেড় বছর। এই দেড় বছর সময়কালকে ৬ মাস করে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম পর্যায় বা ফার্স্ট ফেজে সপ্তাহে ৬ দিন খেলোয়াড়দেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ সময় বেশ কয়েকটি ইনডিকেটরের মাধ্যমে তাদের অবস্থা পরিমাপ করা হবে। প্রশিক্ষণ শুরুর সময় থেকে তারা কতটুকু শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে, পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে, পড়ালেখার ফলাফল, কত ভালোভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারছে, এরকম ১৫টিরও বেশি ইনডিকেটরের মাধ্যমে তাদের পারফরম্যান্স পরিমাপ করা হবে। এছাড়াও খেলাধুলার পারফরম্যান্সের দিকেও নজর রাখা হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এ সময় বিশেষজ্ঞ কোচের অধীনে তাদের ফুটবল নিয়ে আরও ইনটেনসিভ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। একইসাথে কম্পিউটার চালানো কিংবা বিভিন্ন ভোকেশনাল কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এ সময় ফুটবলের পাশাপাশি তারা কোনদিকে দক্ষ সেই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
তৃতীয় পর্যায়ে আবাসিক ডর্মের ব্যবস্থা করা হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের যে বিষয়ে স্বাভাবিক দক্ষতা চোখে পড়বে, সে বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর উদ্দেশ্য তারা যদি ফুটবলার না-ও হতে পারে, তারপরও যেন তারা জীবিকা নির্বাহ করার মতো কোনো কাজ শিখতে পারে।
তবে স্পোর্টস অ্যাকাডেমির মূল লক্ষ্য সবাইকে পেশাদার ফুটবলার হিসেবেই রূপান্তর করা। আর সে লক্ষ্যেই তাদেরকে কোচিং করানো হচ্ছে একজন বিদেশি ও একজন দেশি কোচের অধীনে। এছাড়াও ফুটবল খেলার সময় আহত হলে কিংবা ফিটনেস পরামর্শক হিসেবে একজন ফিজিও, তাদেরকে মাদক-অপরাধ থেকে দূরে রাখার জন্য একজন কাউন্সেলর এবং খেলাধুলা বিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার জন্য একজন স্পোর্টস কাউন্সেলরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এদের সবাই-ই স্বেচ্ছাসেবী, পথশিশুদের একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দেওয়ার জন্য এরা সবাই বিনা পারিশ্রমিকেই পথশিশুদের খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ৩০ বছর ধরে ফুটবল খেলে আসা মার্কিন নাগরিক টম ওয়াইকার্ট কাজ করছেন ঢাকাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিতভাবেই চলে আসেন গুলিস্তানে, ট্রেনিং দেন পথশিশুদের। ওয়াইকার্ট জানান, "প্রথমদিকে বাচ্চাদের মধ্যে টিমওয়ার্কের অভাব ছিল। সবাই একা একাই পারফর্ম করতে চাইতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা শিখছে, ফুটবলে একক নৈপুণ্যের তুলনায় দলগত সাফল্যই আরও বেশি জরুরি। আর এটা শুধু ফুটবলের ক্ষেত্রেই না, জীবনের সবজায়গাতেই।"
পরিকল্পনার মুল লক্ষ্য একটি পূর্ণাঙ্গ স্পোর্টস অ্যাকাডেমি তৈরি করা, যার মাধ্যমে পথশিশুদের স্থায়ী পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হবে বলে জানান মাটি। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছে, তারা চাইলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। অবৈধ পথ নয়, বরং বৈধভাবেই ফুটবলার হওয়ার মাধ্যমে টাকা উপার্জন করা সম্ভব। পথশিশুদের মধ্যেই এই ইতিবাচক মানসিক পরিবর্তন বেশ বড় একটি অর্জন বলে মনে করেন মাটি।
ফুটবলার হওয়ার জন্য ভবিষ্যতে ইংরেজিতে কথা বলায় পারদর্শী হতে হবে এমন একটি ধারণাও তৈরি করা হয়েছে স্পোর্টস অ্যাকাডেমির কিশোর ফুটবলারদের মধ্যে। ফলে তারা তাদের বিদেশি কোচের সাথেই সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারছে। ১২ বছরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরেও অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী যা করতে পারে না, তা মাত্র দুই মাসেই আয়ত্ত্ব করে ফেলেছে বলে মনে করেন মাটি।
চ্যালেঞ্জ
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও পারিপার্শ্বিক আরও কিছু চাপ ছিল বলে জানান মাটি। পথের ইশকুলের শিক্ষা কার্যক্রম ততটা বাঁধার মুখে পড়েনি, যতটা পড়েছে স্পোর্টস অ্যাকাডেমির কাজের সময়। জার্সি কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে মাঠে ট্রেনিং দেওয়ার সময় পর্যন্ত প্রায়ই লোকজনের টিটকারি বা কটূক্তি শুনতে হয়।
"সাধারণ মানুষ মনে করে আমরা পথশিশুদের পেছনে শুধু শুধু শ্রম, সময় আর অর্থ নষ্ট করছি। 'এরা এই টাকা মাদকের পেছনেই খরচ করবে,' 'এরা কখনো ভালো পথে ফিরবে না,' 'এসব ট্রেনিং দিয়ে কোনো লাভ নেই,' এ ধরনের কথা আমাদের প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয়," জানান মাটি। তাছাড়া পল্টন আউটার মাঠেও পথশিশুদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে জেনে অনেকেই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বলেও জানা যায়।
তবে পথশিশুদের পরিবার এ বিষয়ে বেশ আশাবাদী। মাটি জানান, "আগে এই শিশুদের বাবা-মারাই আমাদের কাছে পড়াশোনা করতে আসতে বাধা দিত। কাজে লাগিয়ে দিত ভিক্ষা করতে। কিন্তু স্পোর্টস অ্যাকাডেমির পরিকল্পনা শুনে তারাও তাদের সন্তানদের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছে। তারা মনে করছে এই শিশুরা ট্রেনিং নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।"
মাদক থেকে পথশিশুদেরকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ করে দেওয়ার ফলেও খুশি পথশিশুদের পরিবারগুলো। মাকসুদা নামের এক পথশিশু জানায়, "আমার বাবা-মা ছোট থাকতেই মারা গিয়েছে, আমার ভাই রমজানকে সাথে নিয়ে রাস্তাতেই থাকি। মাঝখানে সঙ্গদোষে ও ড্যান্ডি (জুতার আঠা) খাওয়া শুরু করে। অনেক চেষ্টার পরও ছাড়াতে পারিনি। কিন্তু ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ঢোকার পরই ও নিজেই সব কিছু ছেড়ে দিয়েছে।"
পথের ইশকুল চায় তাদের এই স্পোর্টস অ্যাকাডেমি সামনে আরও এগিয়ে যাবে, কাজ করবে আরও বড় পর্যায়ে। অঙ্কুর থেকে শুরু হলেও একসময় মহীরুহ হয়ে আশ্রয় দেবে ঢাকার পথশিশুদেরকে। শিশুরা যেন খেলতে খেলতে স্বপ্ন দেখা শুরু করতে পারে, নিজেদের ওপর বিশ্বাস আনতে পারে, এবং ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে সেটুকুই প্রত্যাশা তাদের।