দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: পটুয়াখালী উপকূলে ভেঙে পড়ল জাপানি বিমান, সাত ক্রুকে ডাকাত ভেবে বাড়ি ছেড়ে পালাল লোকজন!
১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের আঁচ লেগেছিল পূর্ববাংলায়ও। সে সময় ব্রিটিশ আর আমেরিকার অনেক সৈন্য দেখা গেছে বাংলার রাস্তায়। বেশ কিছু যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়েছে বাংলার মাটিতে। কিছু বাংকার টেকনাফে আজও দেখা যায়। চট্টগ্রাম আর কুমিল্লায় আছে দুটি যুদ্ধ-গোরস্তানও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো যোদ্ধাদের কবর আছে ওগুলোতে।
আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশিরভাগটাই যুদ্ধই হয়েছে আকাশপথে। বাংলার এখানে-সেখানে ভূপাতিত হয় কিছু বিমানও।
উনিশশো বিয়াল্লিশের ডিসেম্বর। জাপানি ও বাঙালি পুলিশের মধ্যে বেশ কিছু যুদ্ধ হয় ওই মাসে।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে, ২৪ ডিসেম্বর রাত ১০টা ৪০ মিনিটে, একটি জাপানি বম্বার ক্র্যাশ-ল্যান্ড করে বাংলার পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া এলাকায়।
বোমারু বিমানটি ক্র্যাশ ল্যান্ড করেছিল সমুদ্রতীর থেকে কয়েক মাল দূরে ধুলাসরে। এ ঘটনার খবরাখবর নিয়ে বেশ কিছু টেলিগ্রাম চালাচালি হয় স্থানীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে। ওইসব টেলিগ্রাম ও প্রতিবেদন ঘেঁটে জানা গেছে এক চমকপ্রদ কাহিনি।
জাপানি ওই বিমানে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট কামানের গোলা আঘাত হানে। গোলার আঘাতে বিমানটি ক্র্যাশ-ল্যান্ড করে ধুলাসরে। ওই বিমানে ক্রু ছিলেন সাতজন। তার সবাই-ই বেঁচে যান। দুজন কেবল সামান্য জখম হন।
ভীত, হতচকিত জাপানি ক্রুরা আশ্রয় ও সাহায্যের জন্য নিকটবর্তী এক বাড়িতে যান। কিন্তু এই অপরিচিত বিদেশিদের দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ওই বাড়ির বাসিন্দারা। জাপানিদের ডাকাত ভেবে বাড়ি ছেড়ে পালান তারা।
রাতের জন্য ওই খালি বাড়িতেই আশ্রয় নেন সাত জাপানি। পরদিন সকালে তারা বের হন সাহায্যের খোঁজে। সমুদ্রপথে পালাতে সাহায্য করবে, এমন কাউকে খুঁজছিলেন তারা। কিন্তু বাংলা ভাষা কিংবা ইংরেজি না জানায় কারও সঙ্গে কথাই বলতে পারছিলেন না বিপদগ্রস্ত জাপানিরা।
ঠিক ওই সময়ই জাপানি যোদ্ধাদের খোঁজে আসে স্থানীয় পুলিশ। একজন হেড-কনস্টেবল ও চারজন কনস্টেবল এসেই জাপানিদের খুঁজতে আরম্ভ করে।
বেলা ১১টার দিকে তারা দেখে, জাপানিরা একটি নদী পার হচ্ছে। জাপানিদের দেখেই তারা গুলি করতে শুরু করে। জবাবে জাপানিরাও পাল্টা মেশিনগানের গুলি ছুড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। গোলাগুলিতে অবশ্য কেউই হতাহত হলো না। বাঙালি পুলিশ নদীর তীরে টহল দিতে থাকে।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে জঙ্গলের আরেক প্রান্ত দিয়ে বের হয় জাপানি বৈমানিকরা। তারপর জেলেদের একটা বড় জেলে নৌকায় উঠে রিভল্ভার ও মেশিনগানের গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালায়। মাঝিরা প্রাণপণে নৌকাটিকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যায়। নৌকাটি চাল ও সবজি বোঝাই ছিল। আর ছিল একটি পাল।
নদী থেকে সাগরে পড়েই নৌকার পাল তুলে দেয় জাপানিরা। এরপর আর তাদের দেখা যায়নি।
বাংলা পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো এক প্রিন্ট করা প্রতিবেদনে বলা হয়, সাগরের ওই অংশ থেকে বার্মায় পৌঁছতে জাপানিদের আনুমানিক চার দিন লাগবে। অনুসন্ধানী এয়ারক্রাফট নিয়ে জাপানি বৈমানিকদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়—কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনের উল্টো পিঠে মন্তব্য করা হয় যে, গ্রামবাসীরা স্বভাবতই ভয় পেয়েছিল। কিন্তু জাপানপন্থি কিংবা ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের কোনোটাই দেখায়নি তারা।