যে কারণে হলিউড তারকা মার্লেকে আমৃত্যু ভারতীয় পরিচয় গোপন করতে হয়েছিল
তিনদিন ধরেই মাথায় ব্যাথা এই ভেবে যে মার্লে ওবেরনকে কেন পরিচয় লুকাতে হলো? যদি মার্লে পরিচয় না লুকাতেন তবে কি কি ঘটত তার একটি তালিকা খুঁজতে লাগলাম, কারণ তাতে প্রশ্নের উত্তর মিলতেও পারে।
সিনেমায় এমনটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়, এই যেমন বলিউডে জায়গা করতে ইউসুফ খানকে হতে হয়েছিল দিলীপ কুমার। আবার ঝর্না বসাককে ললিউডে (লাহোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ভিত শক্ত করতে শবনম নাম নিতে হয়েছিল। মার্লের ব্যাপারটিকেও তেমন মেনে নেওয়া যেত কিন্তু তার ব্যাপারটি একটু বেশি জটিল। কলকাতা থেকে মুম্বাই কিংবা ঢাকা থেকে লাহোর নয় বরং আরও দূরে হলিউডে যেতে চেয়েছিল সে। তাই কেবল নাম নয় ধাম নয়, চৌদ্দগুষ্টির পরিচয় মুছে ফেলতে চেয়েছিল মার্লে। কিন্তু এটা কি দরকার ছিল? এ প্রশ্নের সরল উত্তর হলো, দরকার না থাকলে কে কষ্ট নিতে চায় সেধে?
মার্লে জন্মেছিলেন বোম্বেতে ১৯১১ সালে। পুরো নাম এস্তেলে মার্লে ও ব্রায়েন। তার বাবা পরিস্কার ব্রিটিশ ছিলেন, মা ছিলেন সিংহলিজ ও মাওরি মিশ্রিত। মার্লের জন্মের তিন বছর পর ১৯১৪ সালে বাবা মারা যায়, তারও তিন বছর পর ১৯১৭ সালে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসে মার্লে। এরও তিন বছর পর ১৯২০ সালে অভিনয় শুরু করেন সৌখিন থিয়েটার সোসাইটিতে। উল্লেখ্য মার্লের বাবা ছিলেন ডার্লিংটন থেকে আসা ইন্ডিয়ান রেলওয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পরে তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
মার্লের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আগ্রহ জাগে ভিলমা ব্যাংকিকে দেখে। হলিউডের নির্বাক ছবি দি ডার্ক অ্যাঞ্জেলের নায়িকা ছিলেন ভিলমা। তারপর ১৯২৮ সালে মার্লের ফ্রান্সে যাওয়ার সুযোগ ঘটে, আর্মির একজন কর্নেল (যিনি মার্লের প্রেমে পড়েছিলেন, পরে মার্লের রক্তে মিশ্রধারার কথা জানতে পেরে কেটে পড়েছিলেন) মার্লেকে এক চলচ্চিত্র পরিচালক রেক্স ইংগমারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরিচালক তাকে ছোটখাটো রোল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ফ্রান্স যাওয়ার সময় মা শার্লট শেলবিকে তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন পরিচারিকা পরিচয়ে কারণ মায়ের গায়ের রঙ ছিল কালো। পরের বছরই তারা যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায়।
২০০২ সালে মারে ডেলফস্কি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন নাম, দি ট্রাবল উইদ মার্লে। ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল মার্লের পরিচয় সংকট মেটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কিন্তু আসলে ছবিটি সংকটকে ঘনীভূত করেছে। যেমন ছবিটি জানায়, শেলবি ছিলেন মার্লের নানী।
পরিচালক স্যার আলেকজান্ডার কোর্দা প্রথম বড় সুযোগ করে দিয়েছিলেন মার্লেকে। পরে তিনি মার্লের স্বামীও হয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে নির্মিত কোর্দার দি প্রাইভেট লাইফ অব হেনরি ৮ এর অ্যানে বোলেইন চরিত্র করেছিলেন মার্লে। কোর্দার বিজ্ঞাপনী সংস্থা ছবির প্রচারণার স্বার্থেই মার্লের জাতপাত পরিচয়কে বড় করে তুলতে চেয়েছিল। তখনই তার নতুন জন্মস্থান বলা হয় তাসমানিয়ায় কারণ এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে অনেক দূরে। বিজ্ঞাপনী সংস্থার লোক আরো প্রচার করে, মার্লে তাসমানিয়ার হোবার্টের খুবই ধনাঢ্য এক পরিবারের কন্যা। আর মারে ডেলফস্কির প্রামাণ্যচিত্র বলছে, মার্লে তাসমানিয়া থেকে ভারত যায় পিতার মৃত্যুর পর। তার পিতা মৃগয়ায় গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন আর সেটাই তার মৃত্যুর কারণ।
মার্লে তাসমানিয়ার মেয়ে- কথাটি চাউড় হওয়ার পর অস্ট্রেলীয় মিডিয়া গর্বের সঙ্গে তাকে নিয়ে খবরাখবর চাউড় করতে থাকে। মার্লেকেও শোনা যায় তাসমানিয়াকে তার জন্মভূমি বলতে, কলকাতার কথা চাপা পড়ে যেতে থাকে।
কিন্তু কলকাতা তো তাকে ভোলেনি। উনিশ শ বিশের দশকের কোনো কোনো স্মৃতিকথায় জানা যায়, মার্লে টেলিফোন অপারেটরের কাজ করছে কলকাতায়, নাইটক্লাবে যেতে সে পছন্দ করত আর ফিরপো রেস্তোঁরার এক প্রতিযোগিতায় জিতেছিল। মার্লে পাকাপাকিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি। ১৯৩৫ সালে তিনি অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে হলিউডে তার আসন পোক্ত হয়ে যায় লরেন্স অলিভিয়েরের বিপরীতে ১৯৩৯ সালে ওয়াদারিং হাইটস ছবিতে অভিনয় করে। সেসময়ে ভিভিয়েন লের চেয়েও বেশি নাম ছিল মার্লের। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, এমিলি ব্রন্টির (ওয়াদারিং হাইটসের লেখিকা) অস্থির চরিত্রের নায়িকার জন্য মার্লেই সেরা নির্বাচন।
বর্তমান সময়ে মার্লেকে আবার আলোচনায় আনলেন ময়ূখ সেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন ভারতীয় লেখক। ২০০৯ সালে তিনি মার্লের ব্যাপারে আকৃষ্ট হন কারণ তখন তিনি জানতে পেরেছিলেন মার্লে হচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ায় জন্ম নেওয়া প্রথম অস্কার মনোনয়ন পাওয়া অভিনয়শিল্পী। তারপর যতই জানতে চাইলেন ততই বিষম খেলেন। তিনি আরো জানলেন, পরিচালক কোর্দা আর প্রযোজক স্যামুয়েল গোল্ডউইন মার্লেকে ইংরেজি বলার সেসব কলাকৌশল শিখিয়েছিলেন যা তাকে দক্ষিণ এশীয়দের থেকে আলাদা করেছিল। তবে মার্লের বড় সুবিধা ছিল তার ত্বক যা ছিল প্রায় সাদা, মানে সাদা বলে চালিয়ে দেওয়া কঠিন ছিল না। সেন বলছিলেন, 'সে যুগের সাংবাদিকরা তার পিতা-মাতার তত্ত্বতালাশ করেনি তা ভাবা যায় ন্ তবে মার্লে গুঞ্জনে চুপ থাকার ক্ষমতা রপ্ত করেছিলেন আর সেটা তাকে অনেক বৈতরণী পার করিয়েছে। মার্লে চামড়া সাদাকরণ মানে ব্লিচিং ট্রিটমেন্টও করাতেন নির্দিষ্ট সময় অন্তর। সেটা এক পর্যায়ে তার ত্বককে ক্ষতিগ্রস্তও করেছে।
মার্লে ১৯৩৭ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হন, তাতে তার মুখেও দাগ পড়ে। তখন সিনেমাটোগ্রাফার লুসিয়েন ব্যালার্ড একটি কৌশল প্রয়োগ করেন যেটি মার্লের মুখের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিত আর কালচে ভাব দূর করত। উল্লেখ্য মার্লে কোর্দাকে তালাক দিয়ে ব্যালার্ডকে বিয়ে করেছিলেন ১৯৪৫ সালে। কোর্দার ভাতিজা মাইকেল কোর্দা মার্লের মৃত্যুর পর কুইনি নামে উপন্যাসাকারে একটি জীবনীগ্রন্থ লিখেছিলেন। সেটি পরে একটি টেলিভিশনে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়। তার আগে অবশ্য মার্লে জীবিত থাকা অবস্থায় মাইকেল চার্মড লাইভস নামের একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করেছিলেন। তাতে মার্লের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হওয়ার কথা সন্দেহ করে হুমকির মুখে পড়েছিলেন।
মাইকেল বলেছিলেন, যদিও এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে তবু মার্লে তার অতীত মুছতে চেয়েছে। ১৯৬৫ সাল থেকে মার্লে লোকসমাগমে যোগ দিতই না, একবার অস্ট্রেলিয়ার এক সফর ছোট করে ফিরে এসেছিল কারণ স্থানীয় সাংবাদিকরা কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ময়ূখ সেন জানতে পেরেছেন, ১৯৭৮ সালে তাসমানিয়ায় তার শেষ ভ্রমণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন কারণ লোকে তার আসল পরিচয় জানতে অধিক উৎসাহী হয়ে উঠেছিল।
১৯৮৩ সালে ঘটে আরেক ঘটনা। প্রিন্সেস মার্লে: দি রোমান্টিক লাইফ অব মার্লে ওবেরন নামে একটি জীবনীগ্রন্থ বের হয়। তাতে জীবনীকাররা বোম্বেতে তার জন্মগ্রহণের বার্থ রেকর্ড বের করে। তার ব্যাপটাইজেশন সার্টিফিকেটও খুঁজে পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায় তার ভারতীয় আত্মীয়দের চিঠি ও আলোকচিত্র।
ময়ূখ সেন ধারণা করেন, একজন দক্ষিণ এশীয় নারীর পক্ষে সে কাঠামোর (হলিউড) চাপ নেওয়া সত্যি কঠিন ছিল, যেটি তার জন্য প্রস্তুতই করা হয়নি। আগামীতে সেন তার বইতে এটিই দেখাবেন, অমন একটা ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিদিনই কত কত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন মার্লে ওবেরন। মার্লে ১৯৭৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় মারা যান।
পুরস্কার ঘোষণা
হোবার্টের আর্ট ডিলার নেভিন হার্স্ট ২০০৮ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মার্লে তাসমানিয়ায় জন্মেছে, এটা কেউ প্রমাণ করতে পারলে তাকে ১০ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। নেভিন আশা করেছিলেন, এই ঘোষণা মার্লের জন্মরহস্যের সমাধান দেবে। মার্লে ওবেরন-ফেস অব মিস্ট্রি গ্রন্থের লেখক বব কেসি বলেছেন, মার্লেকে তাসমানিয়ান প্রমাণ করা ততটাই অসম্ভব যতটা জল ওপরের দিকে যাওয়া অসম্ভব।
অনেক দাম দিতে হলো
দি সোপ অপেরা এনসাইক্লোপেডিয়ার লেখক ক্রিস্টোফার শিমেয়ারিং লিখেছেন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ড মুছে দিতে মার্লেকে উচ্চমূল্য গুনতে হয়েছে। দুরন্ত জীবন কাটিয়ে গেছেন মার্লে। একের পর এক জীবনসঙ্গী খুজে বের করেছেন-কোর্দার পরে ব্যালার্ড তারপর ভেনিসের কাউন্ট জর্জিও চিনি তারপর মেক্সিকোর শিল্পপতি ব্রুনো পাগলিয়াই তারপর বয়সে অনেক ছোট সহশিল্পী রবার্ট ওয়াল্ডার। যার অতীত তালাবদ্ধ সে বর্তমানকে উপভোগ করতে পারে না, আর না পারে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে। মার্লের সম্পদ বলতে ছিল তার সৌন্দর্য। তাইতো গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটার পর তাকে কসমেটিক সার্জারিতে যেতে হয়েছে, ইনজেকশন নিতে হয়েছে। চলচ্চিত্রের চেয়েও জটিল চিত্রনাট্যের বাস্তব জীবন ছিল তার। সবসময় অতীত লুকিয়ে বেড়ানো সোজা কথা নয়।
তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন সত্য
দ্য প্রাইভেট লাইফ অব হেনরি আটের পর ডগলাস ফেয়ারব্যাংক সিনিয়রের বিপরীতে অভিনয় করেছেন দি প্রাইভেট লাইফ অব ডন হুয়ানে (১৯৩৪)। একই বছর স্কারলেট পিম্পারনেলে তার নায়ক ছিলেন লেসলি হাওয়ার্ড। পরের বছর ফলিস বারগেরে ছবিতে নায়ক পেয়েছেন মরিস শেভালিয়েরকে। ১৯৪৫ সালের আ সঙ টু রিমেম্বার ছবিতে তিনি ফরাসী লেখিকা জর্জ স্যান্ডের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৫৪ সালের ডিজেইরি ছবিতে তিনি করেছেন নেপোলিয়নের জোসেফাইন চরিত্র। আগে পরে আরো করেছেন লিডিয়া (১৯৪১), ডার্ক ওয়াটারস (১৯৪৪), নাইট ইন প্যারাডাইস (১৯৪৬), বার্লিন এক্সপ্রেস (১৯৪৮), ডিপ ইন মাই হার্ট (১৯৫৪), অব লাভ অ্যান্ড ডিজায়ার (১৯৬৩) ইত্যাদি জমকালো সব ছবি। ওয়াদারিং হাইটসের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। একালের গবেষকরা তাই প্রশ্ন করছেন, সেকালে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানকে রানি, মহারানি, শুয়োরানি বা দুয়োরানির চরিত্রে গ্রহণ করা কি দর্শকের পক্ষে সম্ভব ছিল? সেকালে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের চি চি বলে বিদ্রুপ করা হতো। তাইতো আরেকটি সম্পূরক প্রশ্ন, কোনো প্রযোজক কি একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানকে রানি চরিত্রে অভিনয় করানোর ঝুঁকি নিতেন?
তাইতো ময়ূখ সেন উপসংহার টানছেন এভাবে, "সেসব সংগ্রাম মোকাবেলা করা সহজ ছিল না। তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেয়ে তার প্রতি করুণা এবং সহানুভূতি দেখানোই যথাযথ হবে।"
- বিবিসি অবলম্বনে