অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর থমকে গেছে আইসিইউ, আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন প্রকল্প
আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি কেনা, কোভিড হাসপাতাল নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে এক বছর আগে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার দু'টি প্রকল্প নেয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরুর পর হাসপাতালে বেড, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সংকটসহ রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাগুলো।
১১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ের বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় শুরুতেই কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে তখনকার প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. ইকবাল কবিরকে ওএসডি করার পর তিনজন পিডি নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা কোন কাজ করেননি। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার ও ৫ বেডের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট স্থাপন, ১৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিটিতে ৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার এবং ১০ বেডের আইসিইউ চালুর কথা ছিল।
গত জানুয়ারিতে প্রকল্পটি সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৬১৪ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে মাত্র ১৫৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় কেনা আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটরের বেশিরভাগই এখনও সরকারের গুদামে পড়ে আছে। প্রকল্পের টাকা খরচ করতে না পেরে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা ভ্যাকসিনের মূল্য এখন অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে, এডিবির অর্থায়নে নেওয়া ১৩৬৫ কোটি টাকার প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কোন অর্থ ব্যয় হয়নি বলে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. হেলাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শুরুতে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থায়নে নেওয়া দুই প্রকল্পের পিডি ছিলেন ইকবাল কবির। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় শুরুতে কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে তাকে ওএসডি করার পর দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অনিয়মের তদন্ত করছে। এ কারণে প্রকল্প দু'টিতে নতুন করে পিডি হতে আগ্রহী হচ্ছিলেন না কর্মকর্তারা।
বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে এরপর দু-তিনজনকে পিডি নিয়োগ দেওয়ার আদেশ জারি করা হলেও তারা যোগদান করেননি। সর্বশেষ অনেকটা জোর করে চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ড. আজিজুর রহমান সিদ্দিককে পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, নতুন পিডিও এ পদে থাকতে বিভিন্ন সময় অনীহার কথা জানিয়েছেন। তাছাড়া মন্ত্রনালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তদন্ত এবংবৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদপ্তর এবং বিশ্বব্যাংকের অডিটে কর্মকর্তাদের ব্যস্ততার কারণে প্রকল্পের কাজে তেমন অগ্রগতি হয়নি। অবশ্য সব ধরনের বাঁধা কাটিয়ে কিছু কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিডি ড. আজিজুর রহমান।
মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, কেবল পিডি নিয়োগ দেওয়া কিংবা পিডিদের কাজের অনাগ্রহই নয়, প্রকল্পের আওতায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হতেও আগ্রহ হচ্ছেন না কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দেওয়া হলেও নানা অজুহাতে কমিটির বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন না তারা। ফলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন স্থবির হয়ে আছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প দু'টি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এখন কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় কোন সংকট হত না। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হত, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর সক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পেত।
যা বলছেন প্রকল্প পরিচালক
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চলমান 'কোভিড-১৯ জরুরী প্রতিক্রিয়া এবং মহামারী প্রস্তুতি' প্রকল্পের পিডি ড. আজিজুর রহমান সিদ্দিক বলেন, 'আমি মাত্র চার মাস আগে এই প্রকল্পের দিায়িত্ব নিয়েছি। এর আগে আরও দুইজন কর্মকর্তা তিন-চার মাস করে দায়িত্ব পালন করেছেন। পিডি ছাড়াও কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে'।
তিনি জানান, প্রকল্পে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগের কারণে আগে অনেক দুর্নাম ছিল। অতীতের এমন কিছু কাজের জন্য অগ্রগতি ব্যহত হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার অডিট, তদন্ত, বিভিন্ন সভার কার্যপত্র ও কার্যবিবরনী তৈরির কাজে প্রকল্পের তিন-চারজন কর্মকর্তার সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
এর মধ্যেই কিছু কাজে অগ্রগতি হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, ১৩ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরও ১৭ প্ল্যান্টের কার্যাদেশ দেয়া হবে।
তিনি আরও জানান, ১৩ টি জায়গায় আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই আরও ১৭ টি জায়গায় ১০ বেডের আইসিইউ ইউনিট এবং ২০ বেডের আইসোলেশান সেন্টার স্থাপনের কাজ শুরু হবে।
তিনি আরও জানান, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চাহিদার প্রেক্ষিতে একটি ড্রাগ টেস্টিং ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। দেশে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু হলে এ ল্যাবের মাধ্যমে এর গুণাগুণ যাচাই ও মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এ ল্যাবের মাধ্যমে দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলেও জানান তিনি।
প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের আওতায় ৩০১৮.৬০ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে করোনার ভ্যাকসিন কেনা বাবদ। কোথা থেকে কোন ভ্যাকসিন কেনা হবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসলে জুনের মধ্যেই এ অর্থ ছাড় হবে বলেও জানান তিনি।
গুদামে পড়ে আছে ৩০০ আইসিইউ, ১৬৬ ভেন্টিলেটর
সেকেন্ড ওয়েভ শুরুর পর ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ও হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট দেখা দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপোতে এখনও বিপুল পরিমাণ আইসিইউ বেড, হাই ফ্লো নোজাল ক্যানুলা ও ভেন্টিলেটর পড়ে আছে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় জরুরি এসব উপকরণ হাসপাতালগুলো নিচ্ছে না বলে জানিয়েছে সিএমএসডি।
সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান রবিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'হাসপাতালগুলোর চাহিদা মেটানোর মতো পর্যান্ত ভেন্টিলেটর, আইসিইউ বেড ও হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা আমাদের মজুদ আছে। যেকোন হাসপাতাল থেকে চাহিদা পাওয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে আমরা তা সরবরাহ করতে পারব। কিন্তু এগুলো নিয়ে ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা হাসপাতালগুলো বাড়াতে পারেনি'।
তিনি বলেন, 'আমরা ৪৫০টি আইসিইউ বেড কিনেছিলাম, যার মধ্যে এখনও গুদামে রয়েছে ৩০০টি। ৩০০টি ভেন্টিলেটরের মধ্যে ১৩৪টি বিভিন্ন হাসপাতালে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, ৬০০টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার মধ্যে প্রায় ২৬০টি বিতরণ করা হয়েছে। বাকিগুলো এখনও গুদামে আছে'।