আবরার ফাহাদ: এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের অকাল বিদায়
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মারপিটের শিকার হয়ে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ (২১)। আর এর মধ্য দিয়ে অকালেই বিদায় নিতে হল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে।
আবরারকে রোববার রাত ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, ছোটবেলা থেকেই আবরার ছিল খুব মেধাবী। ক্লাসে প্রথম ছাড়া কখনও দ্বিতীয় হননি। কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের ছাত্র হিসেবে ২০১৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন। সব বিষয়ে এ-প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন সে পরীক্ষায়। মেধার স্বীকৃতি হিসেবে অষ্টম ও দশম শ্রেণিতেও বিশেষ বৃত্তি পেয়েছিলেন আবরার।
পরে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। সেখান থেকে ২০১৭ সালের এইচএসসি পরীক্ষাতেও সব বিষয়ে এ-প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। সেখানে শের-ই-বাংলা হলের ১০১১ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
মেধাবী এই শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষায় মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন। চান্স পেয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেলে কলেজেও। পরিবারের সদস্যরা চেয়েছিলেন আবরার মেডিকেলে ভর্তি হোন। কিন্তু প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আবরার নিজের পছন্দেই বুয়েটে ভর্তি হন।
তার চাচা মিজানুর রহমান বলেন, “আবরার ফাহাদ শিবিরের কর্মী বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এটা বানোয়াট। আবরার উদারমনা ও প্রগতিশীল ছেলে। আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। হানিফ সাহেবের সব অনুষ্ঠানে আমরা অংশ নিই। তবে আবরার এমনিতে মাঝেমধ্যে তাবলিগে যেত। বুয়েটে ভর্তির পরও দু’তিনবার সে তাবলিগে গিয়েছিল। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং পবিত্র কোরআন শরীফ পড়ত।”
ছেলের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে মা রোকেয়া খাতুন বলেন, “রোববার সকালে আমি তাকে নিজে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। এরপর সে ঢাকায় রওনা দেয়। মাঝে তিন থেকে চারবার ছেলের সঙ্গে মুঠোফোনে আমার কথা হয়। বিকাল পাঁচটায় হলে পৌঁছে ছেলে আমাকে ফোন দেয়। এরপর আর কথা হয়নি। রাতে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম, ও আর ফোন ধরেনি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন শোকে বিহ্বল আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন।
মঙ্গলবার সকালে নিজ গ্রাম কুমারখালীর রায়ডাঙ্গা কবরস্থানে ছেলেকে সমাহিত করে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ আবারও সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলেকে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যে ছেলেটা বিকেল ৫টায় ঢাকায় পৌঁছাল, তাকে ৮টার দিকে নির্যাতন করার জন্য ডেকে নিয়ে গেল, ছয় ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালাল, এটা অবশ্যই পরিকল্পিত।”
এদিকে এই হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের বড় কোনো নেতার নির্দেশ থাকতে পারে দাবি করে আবরারের চাচা মিজানুর রহমান বলেন, “এ ঘটনায় কোনো নেতার ইন্ধন রয়েছে। কেননা দু’একজন নয়, সেখানে ১৫ জনেরও বেশি ছেলে আবরার হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া এত জন কাউকে মারতে পারে না।”
আবরারের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, “ভাইয়ার সেমিস্টার পরীক্ষার পড়াশুনার জন্য বাসায় ছুটি না কাটিয়ে রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় কুষ্টিয়া থেকে বাসে ঢাকায় রওনা দিয়েছিলেন। বিকাল ৫টায় পৌঁছানোর পর তার মোবাইলে সে কথা জানান আমাদের। এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি আমাদের সঙ্গে।”
আবরারের মোবাইলে একাধিকবার রিং দিলেও তিনি ফোন না ধরায় মেসেঞ্জারে তাকে ফোন দেন ফাইয়াজ। সেখানে তাকে অ্যাকটিভ দেখা গেলে ও রিং হলেও কেউ ফোন ধরেনি। ফলে পরিবারের সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন।
ফাইয়াজ জানালেন, সোমবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আবরারের এক বন্ধু বুয়েট থেকে প্রথমে খবর দিয়ে বলেন যে, আবরার মারাত্মক অসুস্থ। কিছুক্ষণ পর তাদের আবার খবর দেওয়া হল যে, আবরার মারা গেছেন।