কৃত্রিম প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ব্রাহমার উৎপাদন থেকে সরে আসে সরকার
মাংসের চাহিদা পূরণে ব্রাহমা জাতের গরু উৎপাদনে সরকার এক দশক আগে উদ্যোগ নিলেও তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। কারণ পরীক্ষামূলক উৎপাদন শেষে জাতটি উন্মুক্ত করার আগেই বিশৃঙ্খলভাবে ব্রাহমার প্রজনন শুরু করে খামারিরা। যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ব্রাহমার উৎপাদন থেকেই সরে আসে সরকার।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য ও মাংসের প্রজাতি উন্নত করতে নেওয়া নীতির সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয় অধিদপ্তর। কারণ ব্রাহমার অনিয়ন্ত্রিত প্রজনন দুধের উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে এমন শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে ব্রাহমার উৎপাদন ও আমদানি, ব্রাহমার শুক্রাণু আমদানি, এর মাধ্যমে কৃত্তিম প্রজনন কার্যক্রম বন্ধ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে বিফ ক্যাটেল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পরীক্ষামূলকভাবে ব্রাহমার উৎপাদন শুরু করে। এর আওতা বড় করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সরকার এই প্রকল্পটি পরিচালনা করে। ব্রাহমা জাতের গরু দ্রুত সময়ে বেড়ে উঠে বলে ব্রাহমার উৎপাদনে খামারিদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। প্রকল্পের বাইরেও এর প্রজনন শুরু হয় এবং তা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
কারণ দুই বছরে একটি দেশি গরু থেকে ২০০ কেজি মাংস পাওয়া যায়, যেখানে ব্রাহমা থেকে পাওয়া যায় ৭০০-৮০০ কেজি। কারণ ব্রাহমা হচ্ছে মাংসের একটি উন্নত প্রজাতি।
সরকার প্রকল্পের মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখতে পায়, কৃত্তিম প্রজননের সঙ্গে জড়িত কিছু সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা লোভে পড়ে প্রকল্প এলাকার বাইরে গিয়ে ব্রাহমার প্রজনন ঘটাচ্ছে। যা ছিল পুরোপুরি নিষিদ্ধ এবং সরকার তখনো বেসরকারী পর্যায়ে এর উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করেনি। আর এর প্রভাব পড়তে শুরু করে দুধের উৎপাদনে।
সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ১ লাখ মানুষ কৃত্তিম প্রজনন নিয়ে কাজ করে। যাদেরকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়।
জানা যায়, দেশি গাভীতে ব্রাহমার শুক্রাণু দিয়ে প্রজনন ঘটানো হলে যেসব ফিমেইল ক্যাটল জন্ম নেয় সেগুলো থেকে কোন দুধ পাওয়া যায় না। এখানেই দুধের উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়।
অথচ সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে দুধের উৎপাদন ২০৩১ সালের মধ্যে ২০০ লাখ মে. টনে নিয়ে যাওয়া। যা এখন আছে ১০৬ লাখ টন।
এর পর থেকেই প্রাণিসম্পদ সেক্টরের নীতিনীর্ধারকরা ব্রাহমার বিস্তারে লাগাম টানতে শুরু করে। ব্রাহমা জাতের গরু, সিমেন আমদানি, ব্রাহমার শুক্রানু দিয়ে কৃত্তিম প্রজননে লাগাম টানা হয়। সরকারিভাবে আমদানি করা কয়েক হাজার ব্রাহমার শুক্রাণু ব্যবহার না করে এখন সেগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (এআই) ডা. ভবতোষ কান্তি সরকার বলেন, 'প্রকল্প শেষে ব্রাহমার উৎপাদন খামারিদের মধ্যে উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছে যে প্রকল্প শেষে এটা উল্টো বন্ধ করতে হয়েছে। কারণ প্রকল্পের বাইরে গিয়ে ২০১৬, ২০১৭ সালের দিকে অসাধু কিছু কৃত্তিম প্রজননকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ব্যপকভাবে ব্রাহমার প্রজনন ঘটানো শুরু হয়।'
তিনি বলেন, 'ব্রাহমার প্রজননের মাধ্যমে যে ফিমেল ক্যাটল তৈরি হয় তা থেকে কোন দুধ পাওয়া যায় না। ব্যাপকভাবে এর প্রজনন শুরু হলে দুধ উৎপাদন হুমকিতে পড়বে। যে কারণে ব্রাহমার উৎপাদন থেকে সরকার সরে এসেছে এবং খামারি পর্যায়ে পরবর্তীতে উৎপাদন উন্মুক্ত করা হয়নি।'
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে বিফ ক্যাটেল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রাহমার উৎপাদন কর্মসূচি হাতে নেয়। পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ১১টি উপজেলায় তিন বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে এর কাজ করানো হয়। পরবর্তীতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ৬০ হাজার শুক্রাণু এনে দেশি গাভীতে প্রজনন ঘটানো হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৪৮টি জেলার ১৮৫টি উপজেলার এর বিস্তার ঘটানো হয়।
জানা গেছে, এই ধারাবাহিকতায় এখনো কিছু খামারি ব্রাহমা জাতের গরু পালন করছে। আবার অনেক আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণায় ব্রাহমা গরু দেশে আনছেন।
খামারিদের দাবি, ব্রাহমা আমদানিতে সরকারের কোন আইনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারী পর্যায়ে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনার নীতিমালা-২০১৬ (সংশোধিত) মাধ্যমে এটিকে আমদানি নিষিদ্ধের তালিকায় ফেলা হয়েছে। তবে কেউ চাইলে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে গবেষণার উদ্যেশ্যে এটি আমদানি করতে পারে।
আগে থেকে অনুমতি না থাকায় গত ৬ জুলাই আমেরিকা থেকে রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা ব্রাহমা জাতের ১৮টি গরু জব্দ করে ঢাকা কাষ্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। জব্দ করা গরুগুলো এখন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জিম্মায় সাভার ডেইরি ফার্মে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. শেখ আজিজুর রহমান বলেন, 'এই জাতের গরু আমদানি করতে হলে আগে থেকে পারমিশন নিতে হয়, যথাযথ কারণ দেখাতে হয়। কিন্তু আমদানিকারক সে কাজটি করেনি।'
'আমাদের একটি বিশেষজ্ঞ টিম রয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। আমদানিকারণ যদি সঠিক কারণ দেখাতে পারে এবং বিশেষজ্ঞ টিম যদি কারণটি যৌক্তিক মনে করেন তবেই গরুগুলো ছাড়ের অনুমতি দেয়া হবে।'
তবে এর আগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণা ব্রাহমা জাতের গরু দেশে এনেছিল বলে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
এদিকে গরু আটকের কারণ হিসেবে ঢাকা কাষ্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) মোহাম্মদ আবদুস সাদেক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ ধরনের আমাদানির ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন সনদ ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এনওসি দেখাতে হয়। কিন্তু এগুলো নিয়ে কোন আমদানিকারক আমাদের কাছে আসেনি। যে কারণে গরুগুলো জব্দ করা হয়েছে।'
জানতে চাইলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাদেক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এর আগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই জাতের গরু আমদানি করেছে। তাই আমরাও এনেছি। কিন্তু আগে থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি। আমরা এখন অনুমতি নেয়ার চেষ্টা করছি, অনুমতি পেলে গরুগুলো ছাড় করাতে পারবো।'
এদিকে কিছু খামারি দাবি করেছে, ব্রাহমা মাংসের জন্য সেরা জাতের গরু হলেও তাদেরকে আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন মাংসের জাতের সঙ্গে যত্রতত্র মেইট করানো হলে দেশে দুধের উৎপাদনের উপর একটা প্রভাব পড়বে। যা মোটেও ঠিক না। কারণ খামারিরা এর উৎপাদন করতে চায় মাংসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দেশে মাংসের উৎপাদনের জন্য দেশি জাতগুলোর আরও উন্নয়নের জন্য গবেষণা চলছে। কিন্তু সরকার এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দুধ ও দুদ্ধজাত পণ্য তৈরিতে। যে কারণে দুধ উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ার কোন সুযোগ নেই।