চার দশকে দেশে উল্লুক কমেছে ৮৪ শতাংশ
- দেশের সবচেয়ে বেশি উল্লুকের বসবাস মৌলভীবাজরের রাজকান্দি ও পাথারিয়া ফরেস্টে
- দেশের ২২টি বনে ১৩৫ টি দলে প্রায় ৪৬৮ উল্লুখ আছে।
- ১৯৮০ সালের গবেষণায় বাংলাদেশে যে উল্লুকের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার এখন তা ৪৬৮
- হাজারিখিলসহ কয়েকটি অভয়ারণ্যে দেখা মিলেনি উল্লুকের
- দেশের বনগুলোতে ২৯৪.০৬ বর্গ কি.মি. জায়গা উল্লুকের বসবাসের উপযোগী
বিশ্বব্যাপী বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্ন উল্লুক। সম্প্রতি বাংলাদেশে এই মহাবিপন্ন উল্লুকের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে। দেশে ১৩৫টি গ্রুপে মোট ৪৬৮টি উল্লুকের ধারণা পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রায় ১২২টি উল্লুকের অবস্থান মৌলভীবাজারের রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টে। লাউয়াছড়া বন উল্লুকের জন্য পরিচিত হলেও সেই বনে ১৩টি গ্রুপে ৪০টি উল্লুক পাওয়া গেছে। পূর্বে ছিল এমন অনেক বনে পাওয়া যায়নি উল্লুকের দেখা।
বাংলাদেশে উল্লুকের সংখ্যা নির্ণয়, বর্তমানে উল্লুকের বসবাসযোগ্য বনের অবস্থা ও সম্ভাব্য বনের তথ্য জানার উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি বৃহৎ গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সিলেট ও চট্রগ্রামের ২২টি বনে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এই সময়ে গবেষকরা ১০৯ দিন বনের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন এবং ২০৪.৬৫ কিমি পায়ে হেঁটে তুলে এনেছেন উল্লুকের নানা তথ্য।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবির বিন মুজাফফারের নেতৃত্বে এই গবেষণায় অংশ নেন বাংলাদেশের বন্যপ্রানী গবেষক হাসান আল রাজী চয়ন, তানভীর আহমেদ, সাবিত হাসান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরিজ জারাদাত।
বাংলাদেশ বন বিভাগের অনুমতি ও সহায়তায় আমেরিকার ইউএস ফিশ এন্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিসের অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণাটি চলতি মাসের ৬ তারিখে ডাইভারসিটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকদলের সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে প্রতিবছর ৩.১ শতাংশ হারে কমছে বনভূমি। দক্ষিণ এশিয়াতে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ ৭৯ মিলিয়ন হেক্টর কিন্তু এই সংখ্যাও কমছে দ্রুত।
সারাবিশ্বে উল্লুক জাতীয় প্রানী আছে ১৯ প্রজাতির। দক্ষিণ এশিয়ার ৩ প্রজাতির উল্লুকের মধ্যে বাংলাদেশে কেবল ওয়েস্টার্ন উল্লুকের দেখা মিলে। ১৯৮০ সালে গিটিংস এবং আকন্দের গবেষণায় বাংলাদেশে ৩ হাজার উল্লুকের অনুমান করা হয়েছিল। তবে ১৯৯০ সালের একটি গবেষণায় ২০০টি এবং ২০০৬ সালের একটি গবেষণায় ২৮২টি উল্লুকের কথা বলা হয়েছে। তবে ১৯৯০ এবং ২০০৬ সালের গবেষণায় গবেষকরা যেসব উল্লুক নিজের চোখে দেখেন শুধু সেগুলো গণনা করা হয়েছে। এই দুইটি গবেষণায় সব বনে যাওয়া সম্ভব হয়নি এবং গবেষণায় অন্তত দেশে উল্লুকের সর্বনিম্ন সংখ্যা জানা গিয়েছিল। এটা জানা যায় যে, ১৯৮০ সালের গবেষণায় বাংলাদেশে যে উল্লুকের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার এখন তা ৪৬৮ তে। অর্থাৎ বাংলাদেশে চার দশকে ৮৪ শতাংশ উল্লুক হ্রাস পেয়েছে।
বর্তমানের গবেষণাটিতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তথ্য বিশ্লেষণ গবেষণা করে হয়েছে। দেশের ২২টি বনে ১৩৫টি দলে প্রায় ৪৬৮.৯৬ টি উল্লুক প্রাক্কলন করা গেছে এবং এর থেকে ৪৫.৫টি উল্লুক কম বা বেশী হতে পারে। মূলত যেকোন বন্যপ্রাণী শুমারিতে প্রানীর সংখ্যার একটা মৌলিক ধারণা প্রকাশিত হয়, মানুষের শুমারির মত বনের কোন নির্দিষ্ট প্রাণীর শতভাগ নির্ভুল সংখ্যা বের করা আদতে সম্ভব নয়।
এই গবেষণায় সিলেট বিভাগের ৬টি বনে উল্লুকের ভাল অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে প্রায় ১২২টি, পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে প্রায় ৯১টি , লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪০টি, সাগরনালের বনে ২টি, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ৫টি এবং সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ৯টি উল্লুকের কথা জানা যায়।
এছাড়াও চট্রগ্রাম বিভাগের দীঘিনালা বন, সাজেক ভ্যালি, পাবলা খালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সাঙ্গু-মাতামুহুরি সংরক্ষিত বন, রামু , থানচিসহ ১৮টি বনে এই গবেষণা চালানো হয়। বেশিরভাগ বনে উল্লুকের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও পূর্বে ছিল এমন কয়েকটি বনে এবার আর তাদের দেখা মিলেনি। তার মধ্যে হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যসহ বেশ কয়েকটি বনে উল্লুকের দেখা মিলেনি।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, উল্লুকের আবাসস্থলে প্রতি ১ বর্গ কিলোমিটারে ০.০৬ থেকে ১.৬৯টি উল্লুকের দল থাকার কথা জানা যায় যা গড়ে দাঁড়ায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ০.৩৯টি উল্লুকের দল।
যেসব বনে গবেষণা করা হয়েছে সে সব বনের ২৯৪.০৬ বর্গ কিমি জায়গা উল্লুকের বসবাসের উপযোগী বলে তথ্য উঠে এসেছে। এর বাইরেও পাবলাখালির উত্তর ও কাসালং বন উল্লুকের বসবাসের উপযোগী হিসেবে জানা যায়।
গবেষক দলের সদস্য সাবিত হাসান জানান, বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বন ছাড়াও ভারত (উত্তর-পূর্বাংশ), মিয়ানমার (পশ্চিমাংশ) এবং চীনেও (দক্ষিণাংশে) উল্লুক দেখা যায়। নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে উল্লুকের বাসস্থান, খাদ্য সংকট সৃষ্টি ও শিকার-এদের সংখ্যা হ্রাসের প্রধানতম কারণ। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে উল্লুক শিকারের সাম্প্রতিক কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এদের শিকারের তথ্য মিলেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সমীক্ষা অনুযায়ী, এরা দেশ ও বিশ্বব্যাপী মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। উল্লুকের খাবারের তালিকার বড় জায়গা জুড়েই রয়েছে ফল, এছাড়াও তারা গাছের কচি পাতা, ফুল ও পোকামাকড় খেয়ে থাকে। তারা গাছের মগডালে ঝুলে ঝুলে চলতে পছন্দ করে। যেহেতু তাদের খাবারের বড় অংশ জুড়েই রয়েছে নানান প্রজাতির ফল, সেহেতু তারা মনোকালচার বা সমজাতীয় গাছের বনে থাকতে পারেনা। বাংলাদেশের অনেক প্রাকৃতিক বন কেটে এক সময় সেগুলো বাগান করা হয়েছে, সেসব বন থেকে উল্লুক হারিয়ে গিয়েছে। সরকারের উচিত এসব বনকে আবারও তার প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করা, যে সকল জায়গায় এখনো উল্লুক টিকে আছে, সেসকল জায়গাকে টিকিয়ে রাখা ও তদারকি করা। এতে করে উল্লুকের সংখ্যা যেমন সারা দেশে বৃদ্ধি পাবে একইসাথে অন্যান্য অনেক বন্যপ্রাণীও সংরক্ষণের আওতায় আসবে।
এই গবেষণাকালে গবেষকরা দেখেছেন, যেসব বন সংরক্ষিত সেসব বনে উল্লুকের অবস্থা কম রক্ষিত বা আদতে অরক্ষিত বন থেকে ভাল। এতে উল্লুক রক্ষায় অন্য অনেক বনকে সংরক্ষিত করার দীর্ঘদিনের যে দাবি তার বৈজ্ঞানিক যুক্তি মিলেছে।
এই গবেষক দলের সদস্য বানর গবেষক তানভীর আহমেদ জানান, "যে সব বনে উল্লুক আছে তার বেশীরভাগ বনেই পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন চশমাপরা হনুমান ও লজ্জাবতী বানরসহ নানা বিপন্ন প্রাণীর বসবাস। আমাদের গবেষণা উল্লুক বসবাসকারী বনগুলোকে চিহ্নিত করেছে এবং ঐসব বনে কি পরিমাণ উল্লুক টিকে থাকতে পারে সেটারও একটা স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। এখন ঐ বনগুলোতে উল্লুক সংরক্ষণে সঠিক উদ্যোগ নেয়া হলে তা অন্য প্রাণীদের জন্যও আশীর্বাদ হবে। সে বিচারে সিলেট বিভাগের পাথারিয়া ও রাজকান্দি বনকে উল্লুক অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া জরুরী"।
গবেষকদের এই দাবির প্রেক্ষিতে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, "মৌলভীবাজারের পাথারিয়া ও রাজকান্দিতে এত উল্লুক পাওয়া ভাল খবর। উল্লুক অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন। আমার অফিস থেকে এর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে এই নিয়ে আলাপ করা হবে"।
তিনি আরও জানান, "আমরা উল্লুকের বিষয়ে সচেতন। কিছুদিন আগে লাউয়াছড়ায় উল্লুক চলাচলের জন্য বিশেষ ধরণের সেতু তৈরি করা হয়েছে। তাই উল্লুক রক্ষায় কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে । মোট ৫টা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৪টা রেল লাইনের উপরে ও ১টা রাস্তার উপরে। যা রাস্তা ও রেল লাইনের কারণে সৃষ্ট বনের ক্যানোপির মাঝে যে বিচ্ছেদ ঘটেছে, সেই সমস্যার একটা সাময়িক সমাধান হবে"।
এই গবেষণা প্রকল্পের ম্যানেজার ও গবেষক হাসান আল রাজি জানান, "কিছু বনে উল্লুকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ভালো থাকা আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও তা আসলে খুব বেশী খুশির সংবাদ নয়। উল্লুক পাওয়া যায় এমন সব বনই আসলে ছোট ছোট দ্বীপের মত, একটি অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন। এতে করে এক বনের উল্লুকের সাথে অন্য বনের উল্লুকের কোন প্রকার যোগাযোগ হয় না, ফলে জিনগতভাবেও এক বনের উল্লুকেরা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এক বনের থেকে অন্য বনে উল্লুকদের কোন জিন প্রবাহ না থাকায় টিকে থাকা উল্লুকদের মাঝে জিনগত বৈচিত্র্যতা কমে যাচ্ছে যা উল্লুকদের জন্য একসময় বড় ধরনের হুমকি হতে পারে। কেননা জিনগত বৈচিত্র্যতা কম হলে যেকোন ধরনের দুর্যোগে ( যেমন: রোগ বালাই, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি) সকল প্রাণী একসাথে বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই উল্লুকের জিনগত গবেষণা এখন সব থেকে জরুরী এবং সেই সাথে আমাদের ভেবে দেখতে হবে কিভাবে এই বিচ্ছিন্ন উল্লুকের জনসংখ্যার মাঝে একটা যোগাযোগ তৈরী করা যায়"।
গবেষক দলের প্রধান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুন নাহার জানান, সব চেয়ে বেশী উল্লুক পাওয়া গেছে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি এবং পাথারিয়া রিজার্ভ ফরেস্টে।
পূর্বে হাজারিখিল সহ কয়েকটি বনে উল্লুক থাকলেও বর্তমানে এইসব বনে উল্লুক না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, "উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, মানুষের আগ্রাসনসহ বিভিন্ন কারণে তারা হয় অন্যত্র চলে গেছে, নয়তো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। নিশ্চিত করতে হলে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন এবং সবচেয়ে জরুরি এদেরকে সংরক্ষণ কারণ গত দুই দশকে প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেছে"।
উল্লেখ্য, আইইউসিএনের সমীক্ষা অনুযায়ী, এরা দেশ ও বিশ্বব্যাপী মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। উল্লুক বানরজাতীয় প্রাণীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ হতে ৯০ সেন্টিমিটার, এবং ওজন ৬ হতে ৯ কেজি। পুরুষ উল্লুক আর মেয়ে উল্লুক আকারে প্রায় একই সমান হলেও এদের গায়ের রঙয়ের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের গায়ের রং কালো কিন্তু সাদা ভ্রু রয়েছে। অন্যদিকে মেয়ে উল্লুকের সারা গায়ে আছে ধূসর-বাদামী লোম। গলা ও ঘাড়ের কাছে লোমগুলো আরো বেশি কালো। এছাড়া মেয়ে উল্লুকের চোখ ও মুখের চারপাশে গোল হয়ে সাদা লোমে আবৃত থাকে যা অনেকটা মুখোশের মতো দেখায়। প্রায় ছয়/সাত মাসের গর্ভাবস্থা শেষে শিশু উল্লুকের জন্ম হয়। জন্মের সময় এদের গায়ে ঘোলাটে সাদা লোম থাকে। ছয় মাস পর তা লিঙ্গ অনুসারে কালো বা বাদামি ধূসর রং ধারণ করে। জন্মের ৮ থেকে ৯ বছর পর একটি উল্লুক প্রাপ্তবয়স্ক হয়। উল্লুকের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর।