লাউয়াছড়ায় উল্লুকের জন্য ৫টি সেতু
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা একটি প্রাণীর নাম উল্লুক। এদের ইংরেজী নাম Hoolock Gibbon এবং বৈজ্ঞানিক নাম Hoolock hoolock।
কয়েক দশক আগেও সহজে এদের দেখা মিলত দেশের বিভিন্ন বনে কিন্তু বর্তমান এরা বিপন্ন হওয়ার পথে। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে এদের কিছুটা ভাল অবস্থান মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। তবে লাউয়াছড়া উদ্যানের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রেললাইন ও সড়কপথের কারণে বিভক্ত হয়েছে এই বন যার কারণে উল্লুকের চলাচলে সমস্যা হয়। উল্লুক সাধারণত গাছ থেকে গাছে চলাচল করে।
তবে এবার সড়ক ও রেললাইনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে বনবিভাগ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগিতায় উঁচু গাছের এই প্রাণীর চলাচলের জন্য বিশেষ ধরণের সেতু তৈরী করা হয়েছে। লাউয়াছড়া বনের ভেতরের রেললাইনের উপর ৪টি এবং সড়কপথে একটি- মোট ৫টি সেতু তৈরী করা হয়েছে। চলতি মাসের ২ তারিখ থেকে ৪ তারিখ পর্যন্ত সময়ে এই সেতুগুলো তৈরী করা হয়। বর্তমানে এর সফলতা পরীক্ষার জন্য ক্যামেরা লাগিয়ে রাখা হয়েছে সেতুর মুখে। সফলতা পাওয়া গেলে পরবর্তীতে অনান্য বনেও এইরকম সেতু তৈরী করা হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহারের তত্ত্বাবধানে ও বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের অর্থায়নে একটি গবেষক দল এই উদ্যোগ নিয়েছেন। গবেষক দলে আরও আছেন ইউনাইটেডের আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. সাবির বিন মোজাফফর, ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের বন্যপ্রাণী গবেষক মোঃ সাবিত হাসান, গবেষক হাসান আল-রাজী, নেকমের ফিল্ড ম্যানেজার গবেষক তানভির আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ছাত্র সজিব বিশ্বাস ও তানিয়া আক্তার।
এই দলের প্রধান ড. হাবিবুন নাহার জানান, তারা সেতু নির্মাণে ১০ সেমি. ব্যাসের দড়ি ব্যবহার করছেন এবং মোট ৫টা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৪টা রেল লাইনের উপরে ও ১টা রাস্তার উপরে। ফলে রাস্তা ও রেললাইনের কারণে সৃষ্ট বনের ক্যানোপির মাঝে যে বিচ্ছেদ ঘটেছে, সেই সমস্যার একটা সাময়িক সমাধান হবে।
প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের বন্যপ্রাণী গবেষক মোঃ সাবিত হাসান জানান, তার সর্বশেষ জরিপে লাউয়াছড়ার বনে মোট ১৩টি উল্লুক পরিবারে ৪৩টি সদস্য পেয়েছেন। তিনি গত ১ বছর যাবত ড. হাবিবুন নাহার ও ড. সাবির বিন মোজাফফরের তত্ত্বাবধানে ইউএস ফিশ ও ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিসের অর্থায়নে এই বনে উল্লুকের সংখ্যা, পরিবারের বিন্যাস ও আচরণের উপর গবেষণা কাজ সম্পাদন করেছেন।
তিনি জানান, অন্যান্য বনের তুলনায় লাউয়াছড়ার বনে উল্লুকের ঘনত্ব বেশী হলেও তাদের আবাসিক অবস্থা বেশ বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। এই কৃত্রিম সেতু কয়েকটি ছোট ছোট বনকে একসাথে মিলিয়ে দিবে যা উল্লুক সহ অন্যান্য বানর প্রজাতি ও গেছো প্রাণীর চলাচলের নিরাপদ সেতু হিসাবে কাজ করবে। এছাড়াও রাস্তা ও রেললাইনে চলাচলের সময় যেসব বানর প্রজাতি মারা যেত তার সংখ্যাও কিছুটা কমে আসবে বলে জানান।
বন্যপ্রাণী গবেষক হাসান আল রাজী বলেন, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে লাউয়াছড়া এবং সাতছড়ি বনে সড়ক দুর্ঘটনা এবং তড়িতাহত হয়ে বানর জাতীয় প্রাণীর মৃত্যুর উপর একটা গবেষণা করা হয়। এই গবেষণায় উল্লুকের মৃত্যুর কোন প্রমাণ না থাকলেও সড়ক এবং রেলপথ এদের জন্য একটা বড় হুমকি। আমরা আশা করছি, আমাদের এই উদ্যোগ শুধু উল্লুক ছাড়াও অন্যান্য বৃক্ষবাসী প্রাণীদের নিরাপদে সড়ক ও রেলপথ পারাপারে সহায়তা করবে।
কত দিন পরে বন্যপ্রাণীরা এই সেতু ব্যবহার করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে গবেষকরা জানান, এই সেতুর সাথে পরিচিত হতে ও অভ্যস্ততা গড়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লাগবে। এই কৃত্রিম সেতুর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করতে তারা ক্যামেরা ব্যবহার করছেন। কোন প্রাণী এই সেতু ব্যবহার করে পারাপার করলে নিজে থেকে ছবি তুলে রাখবে এই ক্যামেরা।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, "দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে লাউয়াছড়া বনে উল্লুকের অবস্থান বেশ ভাল। এই সেতুগুলো লাউয়াছড়া বনের বানরজাতীয় প্রাণী বিশেষ করে উল্লুকের জন্য খুবই উপকারী হবে বলে আমরা আশা করছি। কিছুদিনের মধ্যে তারা অভ্যস্ত হয়ে যাবে এই সেতু দিয়ে চলাচলের জন্য। শতভগ সফলতার পর দেশের অন্য বনেও এইসব সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে"।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বন ছাড়াও ভারত (উত্তর-পূর্বাংশ), মিয়ানমার (পশ্চিমাংশ) এবং চীনে (দক্ষিণাংশে) উল্লুক দেখা যায়। নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে উল্লুকের বাসস্থান ও খাদ্য সংকট সৃষ্টি এবং শিকার এদের সংখ্যা হ্রাসের প্রধানতম কারণ।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) সমীক্ষা অনুযায়ী, এরা দেশ ও বিশ্বব্যাপী মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় আছে।
একটি প্রাপ্তবয়ষ্ক উল্লুকের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ হতে ৯০ সেন্টিমিটার, এবং ওজন ৬ হতে ৯ কেজি। পুরুষ উল্লুক আর মেয়ে উল্লুক আকারে প্রায় একই সমান হলেও এদের গায়ের রঙয়ের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের গায়ের রং কালো কিন্তু সাদা ভ্রু রয়েছে। অন্যদিকে মেয়ে উল্লুকের সারা গায়ে আছে ধূসর-বাদামী লোম। গলা ও ঘাড়ের কাছে লোমগুলো আরো বেশি কালো। এছাড়া মেয়ে উল্লুকের চোখ ও মুখের চারপাশে গোল হয়ে সাদা লোমে আবৃত থাকে যা অনেকটা মুখোশের মতো দেখায়।
প্রায় ছয়/সাত মাসের গর্ভাবস্থা শেষে শিশু উল্লুকের জন্ম হয়। জন্মের সময় এদের গায়ে ঘোলাটে সাদা লোম থাকে। ছয় মাস পর তা লিঙ্গ অনুসারে কালো বা বাদামি ধূসর রং ধারণ করে। জন্মের ৮ থেকে ৯ বছর পর একটি উল্লুক প্রাপ্তবয়স্ক হয়। উল্লুকের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর।