ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষরা
রাজধানীর হাতিরঝিলের বাগিচারটেক বস্তি। টিনের ছাউনি দেওয়া একটি ঝুঁপড়ি ঘরের সামনে ঝুলানো আছে একটি টিনের পাত যাতে লেখা 'ভাড়া হবে'। আশপাশের ঘরের লোকজনে জানিয়েছেন, এই ঘরের আগের ভাড়াটিয়া নিজের স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারণ মহামারির কারণে আয়-রোজকার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শহরে আর টিকে থাকতে পারছিলেন না তারা।
শহর ছেড়ে যাওয়া লোকটি বস্তির পাশেই একটা চায়ের দোকান চালাতেন। মহামারির কারণে দেওয়া লকডাউনে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। আয়ের একমাত্র উৎস দোকান বন্ধ থাকায় দিন এনে দিন খাওয়া এই মানুষটার পরিবার চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। বাধ্য হয়েই তাই তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিজেদের পৈত্রিক ভিটা গ্রামে চলে যান তারা।
এই পরিবারটির মতো অন্যরাও যারা ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তারা জানান, শহরে তাদের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাড়িভাড়া। এরমধ্যে মহামারির কারণে চাকরি হারানো মানুষগুলোর ওপর দ্রব্যমূল্যের দামের উর্ধ্বগতিও মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে কাজ করছে।
চাকরির বেতন কমানোর শর্তে যারা নিজেদের উপার্জনের অবলম্বনটি টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন তাদের অনেকেই নিজেদের পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসা এই ফ্ল্যাটগুলো ছেড়ে দিয়ে তারা মেস-বাসার মতো জায়গা খুঁজে নিচ্ছেন।
আব্দুর রউফ নামে এক ব্যক্তি ঢাকার একটি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করতেন। শহরে করনোভাইরাসের সংক্রমণের শুরুর দিকে তার অফিস সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়। ১৫ বছর আগে এই নগরে এসেছিলেন রউফ।
তিনি বলেন, "এই শহরটা ছেড়ে যাওয়া আসলেই খুব কষ্টকর। কিন্তু কী করবো? কোনো বিকল্প নেই। তাই আমি গ্রামে চলে যাবো।"
"আমি জানি, গ্রামে গেলে জীবিকার জন্য সেখানে আমি কোনো কাজ পাবো না। কিন্তু সেখানে তো আমি পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারবো, তিনবেলা খেতে পারবো।"
শাখাওয়াত হোসেন কাজ করেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। মহামারির কারণে তাকে ঘরে বসেই কাজ করার সুযোগ দিয়েছে তার অফিস। কিন্তু গত দু'মাস যাবত তিনি তার বেতনের অর্ধেক পাচ্ছেন অফিস থেকে। কঠিন বাস্তুবতার মুখোমুখি থাকা শাখাওয়াত তাই বাধ্য হয়েই নিজের স্ত্রী সন্তানকে নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে নিজেও উঠেছেন একটি সাবলেট বাসায়।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি আমার পরিবারকে এখানে আবার নিয়ে আসবো। বর্তমানে যে বেতন পাচ্ছি, সেটা দিয়ে সবাই মিলে ঢাকায় থাকা অসম্ভব।"
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিলো ৬৮ লাখ। এরপর থেকে এই নগরের ওপর জনসংখ্যার চাপ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তা মেগাসিটিতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাস ২০১৮ অনুযায়ী ঢাকা শহরের জন্য সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে।
গত এপ্রিলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে এ বছর ১৯ কোটি লোক চাকরি হারাতে পারে।
একই মাসে ঢাকা ভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চালানো এক জরিপে বলা হয়, এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত মহামারির কারণে দেশে দেড় কোটি লোক তাদের চাকরি হারিয়েছে।
ব্র্যাক, ডেটাসেন্স এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের যৌথভাবে চালানো এক জরিপে বলা হয়, মহামারির কারণে দেশে ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষ আর্থিক এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছে। যাদের ওপর এই জরিপ চালানো হয়, তাদের ৩৪ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, মহামারির কারণে বিগত সময়ে তাদের প্রত্যেকের পরিবারের অন্তত একজন মানুষ চাকরি হারিয়েছে।
জরিপ বলছে, ইতোমধ্যে ৭৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে এবং চাকরি হারিয়ে বিদেশ থেকে ১৪ লাখ প্রবাসী দেশে ফেরত এসেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে এপ্রিল পর্যন্ত করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করা ২২ লাখ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে।
করোনার কারণে অন্যসব ব্যবসার মতো রেস্টুরেন্টের ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ঢাকা শহরের রেস্টুরেন্টগুলোতে কাজ করা প্রায় ৯ লাখ কর্মী বর্তমানে বিনা বেতনে ছুটিতে আছে।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন বলেন, "করনোভাইরাসের কারণে এই মানুষগুলোর চাকরি চলে যেতে পারে কারণ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার তেমন কোনো লক্ষণ নেই।"
ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরাইন সুলতান বাহার গণমাধ্যমকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ায় ইতোমধ্যেই ৫০ হাজার ভাড়াটিয়া রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে এবং আরও অনেকেই যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, "বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অনেক ভাড়াটিয়াই বাসা ভাড়া পরিশোধের জন্য সস্তায় নিজেদের আসবাবপত্রও বিক্রি করছেন। বাড়িওয়ালারা তাদেরকে তিন মাসের ভাড়া পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে।"