পূজোর মৌসুমেও মিলছে না কাজ, সংকটে প্রতিমাশিল্পীরা
প্রায় ২৫ বছর ধরে পূজোর প্রতিমা নির্মাণ করেন শঙ্কর পাল (৫৭)। এটিই তার জীবিকা। তবে ২৫ বছরের কর্মজীবনে এমন পরিস্থিতিতে কখনোই পড়েননি তিনি।
সিলেট নগরের দাঁড়িয়া পাড়া এলাকায় গিয়ে কথা হয় শঙ্কর পালের সঙ্গে। নগরের পূজোর বেশিরভাগ প্রতিমাই নির্মিত হয় এই দাড়িয়াপাড়া এলাকায়। সবচেয়ে বেশি প্রতিমা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও এখানে। তার একটি 'সন্তুষি প্রতিমা ঘর'। এই প্রতিষ্ঠানেরই সত্ত্বাধিকারী শঙ্কর পাল।
তিনি বলেন, জীবনে দুর্গা পূজার সময় কখনো বেকার থাকতে হয়নি। বরং কাজের চাপে দম ফেলবারই ফুসরত মেলে না। অনেক অর্ডার ফিরিয়ে দিতে হয়। অথচ এবার পূজো একেবারে সন্নিকটে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ প্রতিমা নির্মাণের অর্ডার নিয়ে আসেনি।
শেষ মুহূর্তে যদি কেউ আসে, এই আশায় নিজেই কিছু প্রতিমা নির্মাণ শুরু করেছেন জানিয়ে শঙ্কর পাল বলেন, ''এগুলো বিক্রি না হলে এবার বিরাট সঙ্কটে পড়তে হবে। খাওয়া-পড়া নিয়ে জীবনে কখনোই এমন সঙ্কটে পড়িনি।''
দুর্গাপূজার আর মাসখানেক বাকী। ২২ অক্টোবর থেকে শুরু হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা। প্রতিবছর এই সময়ে প্রতিমা নির্মাণে ব্যস্ত থাকেন সিলেটের প্রতিমা শিল্পীরা। এমন সময়ে দম ফেলবার ফুসরত থাকে না তাদের। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। এবার প্রায় সকলের অবস্থাই শঙ্কর পালের মতো। কাজ মিলছে না কারোরই।
করোনাসঙ্কটের কারণে এবারের ব্যবসাবাণিজ্যে ধস নেমেছে। মানুষজনও অর্থসঙ্কটে। পূজাও পালন করতে হবে নানা বিধিনিষেধ মেনে। ফলে অনেকেই কাটছাট করেছেন পূজার বাজেটে। প্রতিমা নির্মাণেও পড়েছে তার প্রভাব।
আগের মতো জমকালোভাবে, আগে থেকে অর্ডার দিয়ে চাহিদামাফিক প্রতিমা নির্মাণ করাচ্ছে না কোনো পূজা মন্ডপই। এতে বিপাকে পড়েছেন সিলেট অঞ্চলের প্রতিমা শিল্পীরা। বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন তারা।
অথচ দুর্গাপূজার জন্য সারাবছরই অপেক্ষায় থাকেন প্রতিমাশিল্পীরা। এই সময়েই তাদের ব্যবসা জমে ওঠে। বড় বড় মুর্তির অর্ডার আসে। বৈশাখ থেকেই শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের তোড়জোড়। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস সব ওলটপালট করে দিয়েছে। করোনার কারণে এবার দোলাচলে পূজার উদ্যোক্তারাও।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ের প্রতিমাশিল্পী অঞ্জন পাল বলেন, অন্যান্য বছরের এই সময়ে কাজ করে কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। তবে এ বছর এখন পর্যন্ত প্রতিমা তৈরির তেমন বায়না আসেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র দুটো প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেয়েছি। অন্যান্য বছর এরকম সময়ে ১০ থেকে ১৫টি বড় প্রতিমা তৈরির অর্ডার চলে আসতো।
তিনি বলেন, এমন মন্দা চললে সংসার নিয়ে পথে বসতে হবে।
গত চৈত্র মাস (মার্চ) থেকেই এমন মন্দা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাসন্তীপূজা, শিবপূজা, গণেশপূজা ও মনসাপূজাসহ সকল পূজাতেই প্রতিমা তৈরি করে রেখেছিলাম। কিন্তু এবার জাঁকজমকভাবে এসব পূজা না হওয়াতে কেউ প্রতিমা কিনেননি। প্রতিমাগুলো এখানে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রচুর টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। দুর্গাপূজার এই মৌসুমেও যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে না খেয়ে মরা ছাড়া কোনো পথ দেখছি না।
একই কথা জানালেন সিলেটের প্রতিমাশিল্পী সাগর পালও। তিনি বলেন, এ বছর এখনও হাত গুটিয়ে বসে রয়েছি। করোনার কারণে কেউই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তাই ভরসাও পাচ্ছি না প্রতিমা তৈরি করার। শেষ হয়ে যাওয়া বাসন্তীপূজা, শিবপূজা, গণেশপূজা ও মনসাপূজায় প্রতিমা কিছু তৈরি করলেও কারিগর খরচ ও অন্যান্য সকল খরচ মিলিয়ে কোনো লাভ করতে পারিনি। পরিবার চালাতে হচ্ছে জমানো টাকা ভেঙে।
তিনি আরও বলেন, এ বছর আমি আট থেকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এ ছাড়া প্রথম দিকে কারিগরদের অগ্রিম বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম, যাতে সময়মতো কারিগর পেতে সমস্যা না হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পূজার প্রতিমার বায়না না পেয়ে কারিগরদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
সিলেটে প্রতিমা শিল্পীদের কোনো সংগঠন নেই। তবে সংশ্লিস্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দুই শতাধিক ব্যক্তি এ কাজ করে থাকেন। তারা সকলেই এবার সঙ্কটে আছেন।
সিলেট বিভাগে গতবছর প্রায় দুই হাজার ৫৪৫টি সার্বজনীন দুর্গাপূজা হয়। এর বাইরে পারিবারিক পূজাও হয়েছে কয়েকশ'। প্রতিবছর এ সকল পূজার উপরই নির্ভর করে থাকেন কারিগর ও প্রতিমাশিল্পীরা।
সিলেট নগরীর মাছুদিঘীর পার এলাকায় ত্রিনয়নী সার্বজনীন পূজা কমিটি প্রতিবছর জাকজমকভাবে পূজা করে থাকে।
এই সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব পাল বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে এ বছর সরকারের নির্দেশনা মেনে আমরা পূজা করবো। ফলে অন্যান্য বছরের মতো এবার আর আমরা প্রতিমা ও প্যান্ডেল বড় করবো না। শুধু নিয়ম রক্ষার্থেই পূজা করবো।
তিনি বলেন, এ বছর বাজেটেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। আমাদের পূজার অর্থের অনেকটা যোগান আসতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা সংগ্রহ করে। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণে চাঁদা সংগ্রহ থেকে আমাদের সদস্যের বিরত রেখেছি।
আগামী ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দূর্গোৎসব। ২৩ অক্টোবর সপ্তমী, ২৪ অক্টোবর মহাঅষ্টমী, ২৫ অক্টোবর নবমী ও ২৬ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।
গত ২৬ আগস্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজার আয়োজন সংক্রান্ত ২৬ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছে পূজা উদযাপন পরিষদ।
এ ব্যাপারে পূজা উদযাপন পরিষদের সিলেট মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা বিভাগের জেলা, উপজেলাগুলো থেকে পূজাম-পের পুরো তালিকা পাইনি। তবে এবার পূজোর সংখ্যা অনেক কমবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধির বাধ্যবাধকতা ও আর্থিক সঙ্কটের কারণে জাকজমকও অনেকটা কমে যাবে। আগের মতো উৎসবমুখর হবে না।
তিনি আরও বলেন, এ বছর পূজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা বন্ধ থাকবে। ম-পে আলোকসজ্জা, সাজসজ্জা, আরতি প্রতিযোগিতা, আতসবাজি ও পটকা ফাটানো হবে না।