বুয়েট: নির্যাতনের শিকার হয়ে স্বপভঙ্গের গল্পগুলো
ছোটবেলা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা ছিল আসাদ রহমানের। স্বপ্ন একসময় সত্যি হল, ২০১৭ সালে তিনি ভর্তি হলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে সিট পেলেন আসাদ। এখান থেকেই শুরু হল নতুন যাত্রা। বেশ চমৎকার কাটছিল আসাদের দিনগুলো।
তারপর একদিন হঠাৎ ভেঙে গেল স্বপ্ন। 'নোংরা ছাত্র রাজনীতি' তার সব শেষ করে দিল।
রাতের আঁধারে ছাত্রলীগের কর্মীদের অমানুষিক নির্যাতন চিরতরে পাল্টে দেয় আসাদের জীবন। টানা চার ঘণ্টার এই নিপীড়নের সঙ্গে ছিল অপমান। সেসব মেনে নিতে পারেননি আসাদ। শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিলেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান-- বুয়েট।
আসাদের এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়, বুয়েট ক্যাম্পাসে এর আগেও এরকম হয়েছে। গত ৬ বছরে ছাত্রলীগ কর্মীদের এরকম নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছেন অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি ছাত্রলীগ কর্মীদের এই নির্যাতনের বিষয়টি বুয়েট প্রশাসন জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি কখনও। বুয়েট শিক্ষক সমিতি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেল।
চাপাঁইনবাবগঞ্জের এক দরিদ্র পরিবারে আসাদের জন্ম। জানালেন, "আমার বাবা মুয়াজ্জিন, মা গৃহিণী। আমার জন্য যতটুকু করা সম্ভব ছিল, তার সব করেছেন তাঁরা। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা আর মনে করতে চাই না। নোংরা রাজনীতি আমার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে", বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন আসাদ রহমান।
"ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। নিয়মিত ক্লাস করতাম, পড়াশোনা করতাম। কিন্তু ক্যাম্পাসের এই নোংরা রাজনীতি আমার সমস্ত ধ্বংস করে দিয়েছে।"
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা জানা গেল আসাদের কাছে। যন্ত্র-প্রকৌশল অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাসান সরোয়ার সৈকত ক্যাম্পাসে ছাত্র শিবিরের সদস্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। খুঁজে দিতে পারলে পুরস্কার পাবার কথা তার। কিন্তু এরকম কাউকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আসাদকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে যান সৈকত। চার ঘণ্টা ধরে প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর।
সেই দুঃসহ যন্ত্রণার স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে আসাদকে। বললেন, "পাঁচ-ছয় জন ছাত্রলীগ কর্মী এসে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল হাসান সরয়ার সৈকতের রুমে। ভেতরে ঢুকিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই মারতে শুরু করল। নির্যাতনের পর মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লাম আমি। তারপর বাবা-মাকে জানাই। মা আমাকে যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। তাই বাড়ি চলে গেলাম। আর কোনো দিন বুয়েটে ফিরিনি।"
পরের বছর মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি নেন আসাদ। ২০১৮ সালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে সেখানেই পড়াশোনা করেন।
এখন বুয়েটের স্মৃতি ভুলে যেতে চান আসাদ।
"আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে বুয়েট। সত্যি বলতে কী, আমি এখনও সেই মানসিক চাপ থেকে বের হতে পারিনি। এই যন্ত্রণা থেকে কীভাবে মুক্তি পাব, তা একমাত্র আল্লাহতায়ালাই ভালো বলতে পারবেন"— বললেন আসাদ।
এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি করে পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে আসাদ বললেন, "আমি হল প্রশাসনের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে কোনো রকমের সহযোগিতাই করেননি তারা। তাছাড়া এই লজ্জার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। এখন আর দোষীদের সাজা চাই না আমি।"
আসাদের মতোই ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়ে বুয়েট ত্যাগ করেন আবদুর রহমান। সেটা ২০১৭ সালের ঘটনা। তিনি এখন পড়াশোনা করছেন সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানালেন, বুয়েট ক্যাম্পাসের নোংরা ছাত্র রাজনীতিই তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, "আমার স্বপ্ন, আমার ভবিষ্যৎ, আমার সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে এই রাজনীতি।"
তিনি বলেন, "আমি এখন ভালো আছি। কিন্তু তারা আমার স্বপ্ন আর ক্যারিয়ার ছিনিয়ে নিয়েছে। আমি ওদের ক্ষমা করব না।"
আজও রাতে ঘুম আসে না রহমানের। সেই রাতের টর্চারের অভিজ্ঞতা তার জীবন ওলটপালট করে দিয়েছে। আবরারের মতো তিনিও মারা যেতে পারতেন। কিন্তু বেঁচে যান ভাগ্যক্রমে।
রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র অভিজিৎ কর আহসানউল্লাহ হলে থাকতেন। ছাত্রলীগ নেতার নির্যাতন আর মারধরে এক কানে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি।
অভিজিৎ জানালেন, এ বছরের ২৭ জুনের রাতের ঘটনা সেটা। আহসানউল্লাহ হলের প্রথম বর্ষের ৮/১০ জন ছাত্রকে ২০৫ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যান ছাত্রলীগের কর্মীরা। তারপর এলোপাতাড়ি মারধর শুরু হয়।
রহমান এর প্রতিবাদ করেন। এতে ছাত্রলীগ কর্মীরা খেপে গিয়ে তার কানে আঘাত করেন। এরপর থেকে সেই কানে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন রহমান।
"এসবই করে বেড়ায় বুয়েট ছাত্রলীগ। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে সহপাঠীদের উপর নির্যাতন করা হয় না। আর এক্ষেত্রে বুয়েট প্রশাসনের দায়িত্বহীন আচরণ রীতিমতো সন্দেহজনক"— বললেন রহমান।
বুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতাও ভীতিকর। ছাত্রলীগের কর্মীরা তার কাছে টাকা চাইলে তিনি দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে এক রাতে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।। প্রচণ্ড মারধরের পর তার কানে গরম পানি ঢেলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ফুসফুস আর কানের নানা সমস্যায় ভুগছেন এই শিক্ষার্থী।
বুয়েটের আবাসিক ছাত্ররা জানালেন, বুয়েটে মোট ৮টি আবাসিক হল রয়েছে। প্রতিটি হলে কমপক্ষে ৫টি করে 'টর্চার সেল' রয়েছে ছাত্রলীগের।
শের-ই-বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষটি এরকম একটি টর্চার সেল। এই রুমে অনেক শিক্ষার্থীর উপর টর্চার করা হয়েছে। তার সর্বশেষ শিকার আবরার ফাহাদ। ছাত্রলীগ মাফিয়ার অমানুষিক নিষ্ঠুর নির্যাতনে শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাতে হয়েছে তাকে।
শত শত ভুক্তভোগীর আরও কয়েকজন হলেন, শের-ই-বাংলা হলেরই আবাসিক ছাত্র পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের রুবেল, সোহরাওয়ার্দী হলের ডায়েন নাফিজ প্রধান এবং নজরুল ইসলাম হলে বসবাসরত কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সাইফুল্লাহ।
নির্যাতনের শিকার হবার পর রুবেলকে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখতে হয়েছিল লম্বা সময় জুড়ে। আর সাইফুল্লাহ বুয়েট ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন বা কী করছেন তা কেউ জানে না।
বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউস সানি গণমাধ্যমকে জানান, আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িতরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে আসীন রয়েছেন। তবে তিনি দাবি করেন, হলে এ ধরনের নির্যাতনের বিষয়ে আগে কিছুই জানতেন না।
"আগে জানলে এরকম কিছু হতে দিতাম না"— বললেন সানি।
বুয়েট শিক্ষক সমিতি মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের জীবনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা দিতে বুয়েট প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে।
সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম মাসুদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা নির্যাতন চালায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর।
তিনি জানান, "বুয়েটে এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছরে অনেক শিক্ষার্থী এরকম ভোগান্তির শিকার হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন চুপ থেকেছে। তাই আবরার হত্যার দায় প্রশাসনকেও নিতে হবে।"
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা আলী আবরার হত্যার ঘটনায় দায়ীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবি জানান।
চলতে থাকা এই নিপীড়নের সর্বশেষ ও নির্মম শিকার আবরার হত্যার ঘটনায় এবার তাই ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস থেকে ছাত্ররাজনীতি, বিশেষ করে ছাত্রলীগের রাজনীতি বাতিলসহ মোট ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন তারা।
ছাত্রলীগের কজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বুয়েট ছাত্রলীগের সদস্যরা মনে করে ছাত্রশিবিরের সদস্যদের ধরিয়ে দিতে পারলে আরও উপরের পদ পাবে। যখন এরকম কাউকে পায় না, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হয়।
তারা মনে করেন, এটি অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা।