যে যেভাবে পারে ঢাকা ছাড়ছে
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সারাদেশে কঠোর লকডাউন দেয়া হবে, শুক্রবার রাতে এমন ঘোষণা আসার পর থেকেই ঢাকা ছাড়ার হিড়িক পড়েছে মানুষের মধ্যে। ফলে গত শনিবার মধ্যরাত থেকেই বিভিন্ন জেলার মানুষ ছুটছেন তাদের গন্তব্যে।
গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে চরম ভোগান্তি ও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে এসব যাত্রীরা।
শনিবার কারওয়ান বাজারের ভ্যানচালক কবির মিয়া বলেন, মধ্যরাতে সবজির ট্রাকে করে কারওয়ান বাজারের অনেক শ্রমিক ও ভ্যানচালক ঢাকা ছেড়েছে।
"সোমবার থেকে লকডাউন। বাইরে বের হওয়া যাবে না। কাজও বন্ধ হয়ে যাবে। আর কাজ বন্ধ থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। তাই আগেভাগেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে তারা", তিনি বলেন।
'আপনি কেন যাননি', এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমার গ্রামে কিছু নাই। ঢাকাতেই থাকব…আল্লাহ কপালে যা রাখছে হবে"।
এদিকে শনিবার সকাল থেকে ফেরিঘাটে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে যাত্রীদের প্রচুর মানুষ ভিড় হয়। ব্যক্তিগত যানবাহনের চাপও ছিল। তবে নৌরুটটিতে ফেরি ছাড়া অন্যান্য নৌযান বন্ধ থাকায় মানুষ ফেরিতেই গাদাগাদি করে পার হয়েছে।
কেরাণীগঞ্জ থেকে যাত্রী আব্দুস সালাম জানান, ১০০০ টাকা দিয়ে তারা ৪ জন যাত্রী সিএনজি দিয়ে ঘাট এলাকায় এসেছেন। প্রতিটা চেকপোস্টে তাদেরকে থামতে হয়েছে। শিমুলিয়া ঘাটে এখন ফেরিতে করে তারা পার হবেন।
মাদারীপুরের যাত্রী সালমা জানান, বিয়ে খেতে মিরপুর যেতে তাদেরকে জনপ্রতি ৬০০ টাকার ভাড়া গুনতে হয়েছে শিমুলিয়া ঘাট পর্যন্ত; বাকিটা ফেরিতে পার হবেন। বিয়ের আনন্দ তো দূরের কথা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
মাওয়া নৌ-পুলিশের পরিদর্শক সিরাজুল কবির জানান, বিভিন্ন গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ঘাটে আগত যাত্রীরা পায়ে হেঁটে আসছে। তবে যে ভিড় সৃষ্টি হচ্ছে তা স্বল্প সময়ের জন্য। ১৪টি ফেরি জরুরী সেবার যানবাহন ও এম্বুলেন্স পারাপারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে মানবিকতা বিবেচনায় আগত যাত্রী ও ব্যক্তিগত যানবাহনও পারাপার করা হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন দেব জানান, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ট্রাফিক ও জেলা পুলিশের একাধিক চেকপোস্ট রয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কোন যানবাহন ঘাট মুখে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তাছাড়া প্রতিটি উপজেলাসহ জেলা সদরেই ৬টি চেকপোস্ট রয়েছে। জরুরী সেবা সমূহের দোকান ছাড়া সকল ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-আরিচা ফেরিঘাটেও গ্রামমুখী মানুষের চাপ ছিল। যাত্রীরা রিকশা-ভ্যান, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার এবং পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক এবং পাটুরিয়া-আরিচা নৌরুট হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলার মানুষের যাতায়াত।
যদিও মহাসড়ক এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের একাদিক নিরাপত্তা চৌকি রয়েছে। তারা ঘাটমুখী যানবাহন ও যাত্রীদেরকে আগত পথেই ফেরতও পাঠাচ্ছেন। তবে তাদের নজর ফাঁকি দিয়ে ছুটছেন যাত্রীরা।
"ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় চেকপোস্ট রয়েছে। তারপরও নানা অজুহাতে ও পায়ে হেঁটে মানুষ যাচ্ছে যা ঠেকানো যাচ্ছে না", বলেন গোলড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম।
মাগুরামুখী যাত্রী মফিজুল ইসলাম বলেন, আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় একটি চায়ের দোকান করেন তিনি। স্ত্রী, সন্তান এবং বাবা-মা মিলে মোট সাত সদস্য নিয়ে থাকতেন একটি ভাড়া বাড়িতে। এখন কঠোর লকডাউনের খবর পেয়ে সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন তিনি।
ফিরোজ মিয়া নামের এক হোটেল শ্রমিক বলেন, গাজীপুর কোনাবাড়ি এলাকার একটি হোটেলে খাবার পরিবেশনের কাজ করতেন তিনি। লকডাউনের খবরে হোটেলের সকল শ্রমিককে বাড়ি যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বেতন পরিশোধ করেছেন হোটেল মালিক। সেজন্য গ্রামের বাড়ি যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই বলে মন্তব্য করেন ফিরোজ মিয়া।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম জিল্লুর রহমান বলেন, জরুরী সেবা অব্যাহত রাখতে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ১২টি এবং আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে তিনটি ফেরি চলাচল করছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলমুখী ঘরমুখো কিছু কিছু মানুষ এসব ফেরিতে করে নৌরুট পারাপার হচ্ছে, বলেন তিনি।
ঢাকার গাবতলিতে দেখা যায় বহু মানুষ পায়ে হেঁটে আমিন বাজারের দিকে যাচ্ছে।
কারণ জানতে চাইলে, একজন আব্দুল রউফ বলেন "আমি শনির আখড়া দিয়ে এসেছি, মানিকগঞ্জ যাব। গাবতলিতে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছে। হেঁটে আমিনবাজার যাচ্ছি, সেখান থেকে মানিকগঞ্জের মাইক্রো ছাড়ে"।
আমিনবাজার গিয়ে দেখা যায়, মাইক্রোর পাশাপাশি বিভিন্ন গন্তব্যে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলও চলছে। তারা গাদাগাদি করে যাত্রী নিচ্ছে, ভাড়াও নিচ্ছে তিন-পাঁচ গুণ বেশি।
ভাড়া বেশি নেয়ার কারণ নিয়ে এক মাইক্রো ড্রাইভার আল আমিন বলেন, "খুব ঝুঁকি নিয়ে চালাই। মাঝেমধ্যে পুলিশ ধরে। টাকা দিতে হয়। আবার মাঝে মাঝে ভিন্ন রাস্তায় অনেক ঘুরে যেতে হয়"।
(প্রতিবেদনটি তৈরীতে আমাদের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি এবং মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি সহায়তা করেছেন)