লকডাউন শিথিল হয়, শুধু ভাগ্যের বদল হয় না নিম্ন আয়ের মানুষের
আসন্ন ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে লকডাউন শিথিল করা সত্ত্বেও স্বল্প আয়ের মানুষের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। লকডাউন ছাড়াও বিগত ৫ দিনে তাদের আয়-রোজগারে উল্লেখযোগ্য গতি দেখা যায় নি।
মোহাম্মদ সেলিম বাবুর্চির কাজ করতেন। লকডাউনে সংসার চালাতে শাজাহানপুরে তার বস্তির সামনেই সিগারেট আর চা বিক্রি শুরু করেন। লকডাউন উঠার সাথে সাথে তার বিক্রিও বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে আয়ের উৎস।
"লকডাউন উঠেছে, সবাই এখন বাইরে যেয়ে চা সিগারেট খাচ্ছে। আমার এখানে খাচ্ছে না। তাই দোকান বন্ধ করে দিয়েছি। আবার, সরকার লকডাউন উঠিয়ে দিলেও সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছে। তাই আমরা আর রান্নার কাজও পাচ্ছি না", বলেন সেলিম।
"এই লকডাউনে আমার পরিচিত প্রায় ৫০-৬০ জন বাবুর্চি অভাবের তাড়নায় রিক্সা চালিয়ে বা সবজি বিক্রি করে কোন রকম দিন কাটাচ্ছেন", তিনি যোগ করেন।
ছলছল চোখে মোহাম্মদ সেলিম বলেন, "লকডাউন উঠে গেছে, এখনো না খেয়ে থাকি, আগামী লকডাউনেও আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। সরকার আমাদের কোনো সহযোগিতা বিগত দিনেও করেনি, এখনো করবে না"।
এদিকে লকডাউনের সময় রিক্সা চালকদের আয় বেশি থাকলেও তা কমে গেছে এখন। ভ্যানচালকদেরও আয় নেই। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গার শ্রমবাজারে দিনমজুররা টুকটাক কাজ পেলেও, সেটা পর্যাপ্ত নয় বলে জানান তারা।
"লকডাউন ওঠার পর, এই পাঁচ দিনে আমি গতকাল দুটি ট্রিপ পেয়েছি, আয় হয়েছে মাত্র ৫০০ টাকা। লকডাউনে যে দেনা হয়েছে, সেটা পরিশোধ করার টাকাও আসবে না এই কয়দিনে। তার উপর আরেক লকডাউন আসতেছে সামনে", বলেন ভ্যানচালক মোহাম্মদ শহীদ।
আরেকজন চালক মোহাম্মদ বিল্লাল বলেন, "লকডাউন ওঠার পরে টুকটাক ট্রিপ পাচ্ছি, তবে সেটা দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তার উপর আমাদের অনেকেরই ভ্যান কিনতে ঋণ নেয়া আছে। সেটাও পরিশোধ করতে হবে। সামনের লকডাউনে কোন সাহায্য না পেলে, হয়ত আমরা না খেয়ে মারা পড়ব"।
রিকশাচালক মোঃ মনির হোসেন বলেন, "লকডাউনে আমাদের আয় ভালো ছিল এখন বরং আয় কিছুটা কমেছে। লকডাউনে আমরা এক বেলায় সহজেই ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করতাম। এখন ৫০০ টাকা আয় করতেই দিন-রাত চালাতে হচ্ছে"।
মালিবাগের একটি বস্তির এই বাসিন্দা বলেন, "তারপরও রিকশাচালকরা কিছু আয় করছে, তবে আমার বস্তির অন্য পেশার মানুষের অবস্থা খুব খারাপ। গরীবকে যদি সামান্যতম সুবিধা দিয়ে সরকার লকডাউন দিত তাহলে কোন সমস্যা ছিল না"।
পাশেই দাঁড়ানো লেগুনা চালক নাসির বলেন, "অভাবের কারণে এখন আমি কোরবানির গরুর জন্য ঘাস বিক্রি করা শুরু করেছি। তবে ঈদের পরে কি করব সেটা অনিশ্চিত"।
"এই লকডাউনে আমি কয়েক রাত না খেয়ে ঘুমাতে গেছি। সামনের লকডাউনেও খুব কষ্ট করতে হবে"।
খিলগাঁও শ্রমবাজারের মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, "যদিও লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আমরা টুকটাক কাজ পাচ্ছি। তবে খুব বেশি না, কারণ অনেকের হাতেই টাকা নাই ফলে তারা এই মুহূর্তে কাজ করাতে অনাগ্রহী"।
"সারাদিন কাজ করলে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। আমরা দিন আনি দিন খাই। টানা এক সপ্তাহ কাজ করার পর দুই দিন বসে থাকলে পকেটে টাকা থাকে না। লকডাউন আমাদের জন্য আতঙ্ক। এতে শ্রমিকরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়", তিনি বলেন।
আরেক শ্রমিক টিপু সুলতান বলেন, "আমরা ধার-দেনা করেছি, যে টুকটাক কাজ করছি তা দিয়ে দেনা ফেরত দিতে পারব না। সাত-আট মাসের ঘর ভাড়া বাকি। লকডাউন আমাদেরকে অসহায় করে ফেলেছে। এখনও আমরা মার্কেটে মার্কেটে ঘুরছি একটা কাজের জন্য, কিন্তু তেমন কাজ নাই"।
"লকডাউনের সময়ে হাতে টাকা ছিল না। অনেক রাত না খেয়ে থেকেছি। অবস্থা এমন ছিল যে সকালে আমরা নাস্তা করলে দুপুরে কি খাব জানিনা। সামনের লকডাউনে কারও কাছে ধার পাব সেই সম্ভাবনাও নাই", তিনি বলেন।
এদিকে গোলাম মোস্তফা নামের একজন প্রেস মেশিন অপারেটর তিন মাস আগে চাকরি হারিয়ে, সংসার চালাতে মগবাজার মসজিদের সামনে কোরআন শরিফ ও ইসলামিক বই বিক্রি করেন বর্তমানে।
"এখন ধর্মীয় বইয়ের সঙ্গে মাস্ক বিক্রি করছি। কিন্তু এ আয় দিয়ে সংসার চলাতে পারছি না। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় আছি। প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা ঘরভাড়া। মাস্কও আগের মতো বিক্রি হয় না। গত ৩ মাস আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে চলেছি। সামনের লকডাউনে কিভাবে সংসার চলবে বুঝতে পারছি না", বলেন চিন্তিত মোস্তফা। তিনিও কোন সরকারি সহায়তা পান নি বলেই জানান।