বৃষ্টিতে বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ
রাজধানীর মগবাজার মোড়ে একটি খুপড়িতে মুচির দোকান আছে নেপাল চন্দ্রের। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা উপার্জন করেন তিনি। কিন্তু গতকাল সোমবার দিনভর বৃষ্টি হওয়ায় সারাদিনে কোনো উপার্জনই করতে পারেননি তিনি।
সন্ধ্যার দিকে দেখা যায় বৃষ্টির মধ্যে দোকান পলিথিন দিয়ে ঢেকে এর মধ্যেই মাথা বের করে কাস্টমার খুঁজছেন তিনি। সন্ধ্যায় এসে মাত্র ১০ টাকা পেয়েছেন একটি জুতা সেলাই করে।
নেপাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বৃষ্টি হলে ঐদিন আমার জন্য দুঃখের। সারাদিন শেষে টাকা উপার্জন করে বাসায় ফিরতে না পারলে পরের দিন অর্ধাহারে থাকতে হয়। এই সামান্য উপার্জনে বাসা ভাড়া, সন্তানদের পড়াশোনা খরচ, খাবার খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে একদিন উপার্জনহীন থাকা মানে আরও চাপ। আশা নিয়ে দোকান খুলেছিলাম যদি কিছু উপার্জন হয় কিন্তু মানুষই বের হয়নি বৃষ্টির মধ্যে।'
রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পান-সিগারেট বিক্রেতা মোঃ বশির টিবিএসকে বলেন, 'আজকে (গতকাল) বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হয়েছি কিন্তু ১০০০ টাকার মতোও বিক্রি করতে পারিনি। অন্যান্য দিন আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়।'
শুধু মুচি নেপাল কিংবা হকার বশির নয় সোমবারের বৃষ্টিতে রাজধানীর নিম্নআয়ের অধিকাংশ মানুষই বিপাকে পড়েছেন। বৃষ্টির কারণে অনেক দোকানদারই তাদের দোকান বন্ধ রেখেছেন।
সোমবার রাজধানীর বাংলামোটর, মগবাজার, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁওসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে নিম্ন আয়ের মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, সবাই বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকের সারা দিনে কোনো উপার্জনই হয়নি, আবার কারো কারো স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেকেরও কম উপার্জন হয়েছে।
ইস্কাটনে রাস্তার পাশের সিঙ্গারা, পুরি বিক্রেতা জসিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'অন্যদিন বিকালের মধ্যে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বিক্রি হয়। আজকে ১৫০০ টাকার মতো হয়েছে। আজকে যা তৈরী করেছি সেগুলোর অর্ধেকও বিক্রি করতে পারিনি। সব বিক্রি না হলে খরচ তোলাই মুশকিল হয়ে যাবে।'
তিনি বলেন, 'আজকে দোকান খোলাই ভুল হয়েছে। আমার আশপাশের কেউই দোকান খুলেনি। ভেবেছি খুলছে কিছু বিক্রি হবে। মাসে বৃষ্টির কারণে একদিনও যদি উপার্জন করতে না পারি তবে সেটা মাস শেষে খরচে অনেক প্রভাব পড়ে। মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ আছে সংসারে। একটি বৃষ্টির দিন মানেই অশান্তির দিন।'
মগবাজারে ফল বিক্রেতা মো. মাসুম টিবিএসকে বলেন, 'সকাল থেকে ২০০ টাকাও বিক্রি করতে পারিনি। অন্যদিন ১৫০০ টাকার মতো বিক্রি হয়। অনেক আশা করে আসছিলাম কিন্তু তেমন কাস্টমারই পাইনি।'
বাসে চিপস, পানি, পপকর্ন বিক্রেতা নয়ন বলেন, 'সারা দিনে ৩০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। রাস্তায় বাস কম আবার অধিকাংশ বাসেরই দরজা বন্ধ থাকে বৃষ্টির কারণে। অন্যান্য দিন ১৫০০ টাকার মতো বিক্রি হয়।'
আগারগাঁও এলাকায় ভ্যানে সবজি বিক্রেতা কালাম হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'যে টাকা দিয়ে সকালে সবজি কিনে বের হয়েছিলাম সেই টাকাও তুলতে পারিনি। অর্ধেক সবজি অবিক্রিত আছে। ক্রেতা না থাকায় এখন কেনা দামের থেকেও কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।'
রিকশা চালক ফারুক টিবিএসকে বলেন, 'আজ (গতকাল) রাস্তায় রিকশাও কম, মানুষও কম। বৃষ্টির মধ্যে ৪-৫ ঘণ্টা চালিয়েছি এতে ৪০০ টাকার মতো উপার্জন হয়েছে। আরও কিছিুক্ষন থাকলে আয় ভালো হতো কিন্তু এতো ভিজতে পারবো না। আগেই বাসায় চলে যাবো। অন্য সময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ১০০০ টাকার মতো আয় হয়।'
কারওয়ানবাজার এলাকার চায়ের দোকানদার মুকুল শেখ টিবিএসকে বলেন, 'অন্য দিনে যা বিক্রি হয় তার অর্ধেকও বিক্রি করতে পারিনি। সকালে বেকারির যে রুটি, কেক রেখেছিলাম এখন সেগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাশের দোকান বন্ধ থাকায় ভেবেছিলাম বিক্রি ভালো হবে কিন্তু এখন ভাবছি বন্ধ রাখলেই ভালো ছিল।'
এদিকে বৃষ্টির কারণে রাজধানীর অন্যান্য দোকানপাটসহ হোটেল, রেস্টুরেন্টেও মানুষের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। অনেকে দোকান খুলে সারাদিন অলস সময়ই কাটিয়েছেন।
ফার্মগেট এলাকার একটি হোটেলের ম্যানেজার শাহরিয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'হোটেল খোলা রেখেছি বলতে পারেন নিয়ম রক্ষার্থে। সন্ধ্যার সময় যেখানে হোটেলে মানুষকে জায়গা দেওয়া কষ্ট হয়ে যায় সেখানে আজকে লোকজনই নেই। হোটেলের খরচ উঠলেই হয়।'
মগবাজারের এক মুদি দোকানি সামিউল বলেন, 'অন্যদিনের চেয়ে বিক্রি এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত কেউ দোকানে আসছে না। আমিও দোকানের অর্ধেকটা খোলা রেখেছি। বৃষ্টিতে পণ্য নষ্ট হয়েছে কিছু কিছু।'
গতকালের বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন রাইড শেয়ার করা মোটরসাইকেল চালকরা। অনেকেই বৃষ্টির কারণে বের হয়নি আবার যারা বেরিয়েছিলেন তাদের উপার্জন ছিল একেবারেই কম।
রাজিব হোসেন নামে এক রাইড শেয়ারিংয়ের চালক বলেন, 'অন্যদিন তিনটায় অফিস শেষ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা উপার্জন হয়, আজকে রাত ৮ টা পর্যন্ত কোনো রাইডই পেলাম না। আজকে হয়তো খালি হাতেই ফিরতে হবে।'