বাজার কারসাজি: অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহি করানো সহজ হবেনা
বাজার কারসাজির অভিযোগে একাধিক করপোরেট কোম্পানির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করার পর এখন জটিলতায় পড়েছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)।
প্রতিযোগিতা কমিশন স্ব-প্রণোদিত হয়ে চাল, আটা-ময়দা, ডিম, মুরগি এবং টয়লেট্রিজের উৎপাদন ও বাজারজাতকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা দায়ের করে গত সেপ্টেম্বরে।
অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার অভিযোগ এনে এ মামলাগুলো করা হয়। এখনো সেগুলো বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কর্মকর্তারা অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে এসব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। তারা বলছেন, কমিশন অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এবং শক্ত কোনো প্রমাণ ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নূরজাহান গ্রুপের কথাই।
নূরজাহান গ্রুপের তাসমিন ফ্লাওয়ার মিল লিমিটেড ভাড়া নিয়ে প্রায় ৬ বছর ধরে আটা-ময়দার উৎপাদন ও বাজারজাত করছে এসিআই পিওর ফ্লাওয়ার লিমিটেড।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রাপ্ত আইনি নথি অনুযায়ী, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত কোনো ধাপেই নূরজাহান গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও আটা-ময়দার বাজারে কৃত্তিম সংকট তৈরি ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন মামলা করেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
এদিকে নূরজাহান গ্রুপের দায়মুক্তির আবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের আগষ্টে এসিআই পিওর ফ্লাওয়ার লিমিটেড নির্দিষ্ট চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ৫ বছর মেয়াদে তাসমিন ফ্লাওয়ার মিল ভাড়া নেয়। ২০২১ সালে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়।
এ সময়ের মধ্যে তাসমিন ফ্লাওয়ার মিল এসিআইয়ের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী ক্রাশিং চার্জ গ্রহণ করে। এই কারখানা থেকে যে পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, মান সংরক্ষণ ও মূল্য সংক্রান্ত সব বিষয় এসিআইয়ের এবং বাজারে এই পণ্যগুলো এসিআইয়ের ব্র্যান্ড নামেই বিক্রি হয়।
কিন্তু প্রতিযোগিতা কমিশন স্ব-প্রণোদিত হয়ে নূরজাহান গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এই প্রেক্ষিতে দায়মুক্তির আবেদন গ্রুপটির পক্ষে দায়মুক্তির আবেদন করেছেন গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, মো. আবু সায়েদ।
বিচারাধীন বিষয় হওয়ায় এই কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে কোন ধরনের মন্তব্য করতে চাননি।
প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন টিবিএসকে বলেন, "অনেক প্রতিষ্ঠানই মনে করছে তারা দায়মুক্তি পেতে পারে। সে কারণে আবেদনও করছে অনেকে। তবে বিচার প্রক্রিয়ার এখন শেষ ধাপে আছি আমরা; রায়ের সময়ই বোঝা যাবে কে অপরাধ করেছে, কে করেনি।"
বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে কথা হয় টিবিএসের। কোম্পানিগুলো তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং অব্যাহতির জন্য কমিশনে আবেদন করেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অভিযোগ তুলে জানান, কমিশন নিজেরা কোন প্রকার বাজার বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ও যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়াই গনহারে মামলাগুলো দায়ের করেছে। যা আসলে কোম্পানিগুলোকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছে।
এসব কোম্পানির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বাজার বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ও পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়াই বিসিসি মামলাগুলো করে কোম্পানিগুলোকে সমস্যায় ফেলেছে।
যদিও কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "যারা অপরাধ করে তারা সেটা কখনোই স্বীকার করে না। এখানেও একই ঘটনা ঘটছে।"
"তবে কিছু কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে, যেগুলো শুনানিতে উঠে এসেছে। এই সুযোগটাই বেশিরভাগ কোম্পানি নিতে চাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায় তখন দেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে আটা ময়দার দাম।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারের দাম বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক হওয়ার কারণে আটা-ময়দার স্থানীয় বাজারজাতকারী ৮ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের একটি বড় শিল্পগ্রুপের (আটা-ময়দার উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, যেসব অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে সেসব বিষয়ে কমিশন সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন দৈনিক পত্রিকার নিউজ। কিন্তু যেসব ধারায় মামলা করেছেন, শুনানিতে দেখা গেছে সেগুলো অভিযোগের সঙ্গে মিলছে না।
প্রথম দিকের শুনানিগুলোতে দেখা গেছে কমিশনের কাছে কোন প্রকার বাজারের প্রকৃত তথ্য নেই।
এই শিল্পগ্রুপটি মোট চারটি শুনানিতে অংশ নিয়েছে এবং তারা বিষয়গুলো তুলে ধরে মামলা খারিজের আবেদন করেছেন।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, কর্মকর্তারাও মামলার কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে দেখেছেন বেশিরভাগ কোম্পানির বিরুদ্ধেই অভিযোগের সুনির্দিষ্ট ভিত্তি নেই। শুনানিতেও কমিশনের এসব দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
টয়লেট্রিজ এর বাজারে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে ৫টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
এরমধ্যে দায়মুক্তির আবেদন করা এক কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কমিশনের হাতে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ না থাকার পরও মামলা করেছে। শুনানিতে কোম্পানির অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে।
ডিম উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস লিমিটেড একদিনের মধ্যে ডিমের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে সারাদেশে অস্থিরতা তৈরির পেছনে তাদের ভূমিকা উঠে এসেছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানটির ভুমিকাকে ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরির প্রেক্ষাপট হিসেবে কমিশনের বিভিন্ন শুনানিতেও উঠে এসেছে।
মামলাগুলো দায়েরের আগে তাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ছিল কিনা জানতে চাইলে কমিশনের সাবেক চেয়ারপার্সন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, "আমি যেহেতু অবসরে, সেহেতু এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার নেই।"