২৭ বছর পর মন্ত্রীহীন ‘মর্যাদার আসন’: সিলেটের ৪ মন্ত্রীর বাদ পড়া নিয়ে নানা আলোচনা
দেশের রাজনীতিতে সিলেট-১ আসন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কিংবদন্তি আছে, এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী নির্বাচিত হন সে দলই সরকার গঠন করে। স্বাধীনতার পর থেকেই এমনটি হয়ে আসছে। এছাড়া এই নির্বাচনী এলাকার মধ্যে থাকা দুই ওলির মাজার জিয়ারত করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে প্রায় সব বড় দল। ফলে সিলেট-১ আসনের রয়েছে আলাদা মর্যাদা।
সিলেট-১ আসনে সব দলই ভিআইপি প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়। নির্বাচনে বিজয়ের পর মন্ত্রীসভারও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান তারা। এবারও সিলেট-১ আসনে ভিআইপি প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। নৌকা প্রতীক নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ীও হন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। কিন্তু এবার মন্ত্রীসভায় ঠাঁই হয়নি তার। এতে করে প্রায় ২৭ বছর পর মন্ত্রীত্ব হারালো সিলেট সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-১ আসন।
গত ২৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যে দলের প্রার্থীই এই আসনে, বিজয়ী হয়েছেন তার দল সরকার গঠন করেছে এবং তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। এর আগে সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে সিলেট-১ আসন থেকে বিজয়ী সংসদ সদস্যকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি।
১৯৯১ সালে সিলেট থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন খন্দকার আব্দুল মালিক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। হুমায়ূন রশীদকে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত করে।
২০০১ সালে বিএনপি থেকে এই আসনে এমপি হন এম. সাইফুর রহমান। বিএনপি ও জোট সরকারের মন্ত্রীসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এর আগে বিএনপি ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পরও সাইফুর রহমানকে টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী করা হয়।
২০০৮ ও ২০১৪ সালে এই আসন থেকে নির্বাচিত হওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। সাইফুর রহমান, আবুল মাল আবদুল মুহিত ও শাহ এএমএস কিবরিয়ার কারণে দেশের রাজনীতিতে সিলেট মানেই অর্থমন্ত্রী, এমন একটা ধারণা জন্ম গিয়েছিল। এই তিনজন মিলে প্রায় ২৭ বছর দেশের অর্থ মন্ত্রণালয় সামলান। নির্বাচিত সরকারের পাশাপাশি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী এবং এরশাদের শামসানামলে মুহিত অর্থ মন্ত্রণালয় এবং হুমায়ূন রশীদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলান।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আবুল মাল আব্দুল মুহিত রাজনীতি থেকে অবসর নিলে তার ভাই আব্দুল মোমেন সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হন। সে নির্বাচনে জয়ী মোমেনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবার আবার এ আসন থেকে মোমেন নির্বাচিত হলেও মন্ত্রীসভায় ঠাঁই হয়নি তার।
কেবল মোমেনই নন, শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি সিলেট বিভাগের আরও তিন মন্ত্রীর। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহাবুদ্দিন নেই নতুন মন্ত্রীসভায়। সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীও নেই এবারের মন্ত্রীসভায়। আর টানা দুই মেয়াদ শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা নুরুল ইসলাম নাহিদ বাদ পড়েছেন গত সরকারেই।
মন্ত্রিসভা থেকে তাদের বাদ পড়ায় সিলেটজুড়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। হতাশ তাদের অনুসারীরা। অতিকথন, স্বজন ও অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাদ পড়তে পারেন বলে আগেই ধারণা করছিলেন অনেকে। পরিবেশমন্ত্রীর স্বজনদের বিরুদ্ধেও ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তার দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। ইমরান আহমদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে তার দূরত্ব ছিলো। তবে ক্লিন ইমেজ ও উন্নয়নবান্ধব হিসেবে পরিচিত পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান মন্ত্রীসভায় না থাকায় বিস্মিত অনেকেই। তিনি আবারও মন্ত্রী হচ্ছেন বলে ধারণা ছিল অনেকেরই।
নতুন মন্ত্রিসভায় সিলেট বিভাগ থেকে দুজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। মৌলভীবাজার-৪ থেকে সাতবার নির্বাচিত মো. আব্দুস শহীদ এবার প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হয়েছেন। তাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হয়েছেন খ্যাতিমান চিকিৎসক সামন্তলাল সেন। সিলেটের বিশ্বনাথের সন্তান সামন্তলাল পেয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। আর সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত শফিকুর রহমান চৌধুরীকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।
সিলেট থেকে এবার মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বেসকারি চাকরিজীবী শাহাদাত হোসেন বলেন, 'এমনিতেই সিলেট উন্নয়নবঞ্চিত। নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এখন মন্ত্রীর সংখ্যাও কমে গেছে। এতে সিলেট আরও বৈষম্যের শিকার হবে।'
সিলেট বিভাগের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে উর্বর এলাকা হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ। হাওরবেষ্টিত এই জেলা থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনের মতো রাজনীতিবিদরা উঠে এসেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও ছিলেন তারা। আর দুই মেয়াদে মন্ত্রী ছিলেন এমএ মান্নান। এবার মন্ত্রীহীন সুনামগঞ্জ জেলা।
এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে প্রকাশক রাজীব চৌধুরী বলেন, 'এমএ মান্নানের উদ্যোগে বেশকিছু উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। সুনামগঞ্জে রেল যোগাযোগ চালুসহ আরও কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা তার ছিল। এখন এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকও এবারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেতে পারেন বলে আশা ছিলো আমাদের।'
এমএ মান্নান মন্ত্রী না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে লেখক ও গবেষক হাসান মোরশেদ ফেসবুকে লেখেন, 'সরকারের সদ্য শেষ হওয়া মেয়াদে সুনামগঞ্জ থেকে পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন একজন। এম এ মান্নান। পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। …এম এ মান্নান তার ব্যক্তিগত সরল ও ভদ্র আচরণ এবং নির্বাচনী এলাকাসহ সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে বিপুল পরিমাণ কর্মযজ্ঞের বিনিময়ে বিরোধীদেরও মন জয় করে নিয়েছিলেন। জাদুকাটা ও কুশিয়ারা নদীর উপর সেতু, সুনামগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, নার্সিং ইন্সটিটিউট, কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আধুনিক হাসপাতালসহ একটা অঞ্চলে জনবান্ধব যত রকম প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব—এম এ মান্নান এর অনেকটুকুই করেছেন।
'এম এ মান্নান এবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত হননি। আগের দুই মেয়াদে মন্ত্রিপরিষদে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে তৃতীয়বারের মতো মন্ত্রী না-ই করতে পারেন। অন্যদেরও সুযোগ পেতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে।
'তবে এম এ মান্নানের ব্যক্তিগত সততা, অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা অন্য কোনো ফরম্যাটে হলেও প্রধানমন্ত্রী কাজে লাগাতে পারেন। আমার ধারণা রাষ্ট্রকে দেয়ার মতো সময় তার এখনো আছে। তাকে স্রেফ সংসদ সদস্য করে রাখা একটা গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্সের অপচয় হবে।'
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, 'মন্ত্রী করা না করা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। কাকে কোথায় প্রয়োজন তিনি তা ভালো বুঝেন। তবে যারা এবার সুযোগ পাননি তারাও যোগ্য। নতুনদের সুযোগ দিতেই তারা বাদ পড়েছেন। নিশচয়ই অন্য কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের মূল্যায়িত করবেন।'