প্রথমদিনেই আবাসিক হলে সিট বুঝে পেলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এতদিন কাগজে-কলমে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বিগত দুই দশকে অছাত্রদের সিট দখল, রাজনৈতিক প্রভাব, পোষ্যদের আধিপত্য ও অপরিকল্পিতভাবে নতুন বিভাগ খোলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠাকালীন আবাসিক গৌরব হারিয়েছিল।
নবীন শিক্ষার্থীদের জায়গা হতো হলের কমন রুম, ডাইনিং রুম, রিডিং রুম, সংসদ রুম, নামাজের কক্ষ কিংবা সাইবার রুমের মেঝেতে। সেখানে গাদাগাদি করে একজনের জায়গায় তিন থেকে চারজন শিক্ষার্থীকে থাকতে হতো। প্রথম বর্ষের পুরো সময় গণরুমে পার করে দ্বিতীয় বর্ষে তারা পেতেন 'মিনি গণরুম'। মিনি গণরুমে দু'জনের জায়গায় ছয় থেকে আটজন এবং চারজনের রুমে ১৪ থেকে ১৬ জন থাকত।
দ্বিতীয় বর্ষ পার করে তৃতীয় বর্ষে এসে সিট পেলেও 'পলিটিক্যাল' বা 'নন-পলিটিক্যাল' পরিচয়ের ভিত্তিতে চারজনের রুমে ৬-৭ জন থাকতে হতো। চতুর্থ বর্ষ বা মাস্টার্সে এসে শিক্ষার্থীরা চারজনের রুমে থাকার সুযোগ পেতেন। এ চিত্র ছাত্রদের হলগুলোর নিয়মিত দৃশ্য ছিল। মেয়েদের হলে অপেক্ষাকৃত আগে সিট পাওয়া গেলেও, তাদেরও প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষে গণরুমে থাকতে হতো।
তবে এ বছর এক ভিন্ন চেহারায় ফিরেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম দিন থেকেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য হলের নির্ধারিত সিট বরাদ্দ করা হয়েছে। সবাই বরাদ্দকৃত সিটে উঠেছেন।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী হল থেকে চলে গেছেন। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অবৈধভাবে সিট দখল করে থাকা নেতাকর্মীরাও হল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে প্রত্যেক বৈধ শিক্ষার্থী তার সিট পেয়েছেন।
আজ শনিবার (১৯ অক্টোবর) সকাল থেকে নবীন শিক্ষার্থীরা নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দকৃত সিট বুঝে পেয়েছেন। প্রতিটি হলে তারা একটি বিছানা, টেবিল এবং চেয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন। কক্ষ অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ সিটে উঠেছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন হলে নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ করতে নানা আয়োজন করেছে হল প্রশাসন ও হলের শিক্ষার্থীরা। নবীনদের ফুল, কলম এবং মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা তালিকা অনুযায়ী স্বাক্ষর করে তাদের নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করেন।
প্রথম দিনেই হলে উঠতে পেরে শিক্ষার্থীরা আনন্দ প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা হলের ছাত্রী এবং ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নাবিলা বিনতে হারুন বলেন, 'আগামীকাল আমাদের ক্লাস শুরু হবে। তার একদিন আগেই হলে উঠতে পারলাম। গণরুম জটিলতা, র্যাগিংয়ের ভয় ছিল, কিন্তু কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা নির্ধারিত সিটে উঠতে পেরেছি।'
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক ছাত্র এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী জিন্নুরাইন স্বাধীন বলেন, 'প্রথম দিনেই হলে সিট পেয়ে স্বপ্নের মতো লাগছে। যারা এ পরিবেশ সম্ভব সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আশা করি ভবিষ্যতেও এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।'
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আবাসিক ব্যবস্থার ফিরে আসায় শিক্ষকেরাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আদনান ফাহাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, 'সরাইলের মেধাবী ছাত্রী তারিন জাবির তারামন বিবি হলে নয়তলায় সিট পেয়েছে। এটা বিশাল ব্যাপার। জাহাঙ্গীরনগরে আমার ১২ বছরে দেখা প্রথম ঘটনা যে, নতুন ব্যাচের ছেলে-মেয়েরা ক্যাম্পাসে ঢুকেই সিট পেয়ে গেল।'
তিনি আরও লিখেছেন, ২০০০ সালে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে ভাসানী হলে তার 'এক রাত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল'। বড় ভাইয়ের রুমে থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। চারজনের রুমে দু'জন থাকতেন। জাহাঙ্গীরনগর একসময় পুরোপুরি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যায়। অনেকদিন পর সেই পরিবেশ আবার ফিরে এসেছে।
উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, 'নবীন শিক্ষার্থীরা তাদের হলে প্রথম দিনেই সিট পাবে — এটা তাদের অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করতে পেরে আমরা আনন্দিত।'
তিনি আরও বলেন, 'শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আবাসিক হল এবং অ্যাকাডেমিক ভবনে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করব।'