উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বেশিরভাগ নাগরিক আশাবাদী, তবে রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে: জরিপ
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/08/p_1-citizens-confidence-survey_2-lead_0.jpg)
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নাগরিকরা আশাবাদী, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নিয়ে বিভাজন রয়েছে। জুলাই-পরবর্তী বিদ্রোহের সময় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা সবচেয়ে বেশি থাকলেও, পুলিশসহ কিছু সরকারি সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং এ বছর জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়তে পারে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক নাগরিক আস্থা জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ একে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন।
জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও, তারা নির্বাচনি সংস্কার, রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এবং দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির ব্যাপারে উচ্চ প্রত্যাশা প্রকাশ করেছেন। গবেষণা সংস্থা ডেটাসেন্স ও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর যৌথ উদ্যোগে 'ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স বাংলাদেশ (ইআইবি)' শীর্ষক প্রকাশনার জন্য করা জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপে মিশ্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে—৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী, তবে ১৬ শতাংশ মন্দার আশঙ্কা করছেন এবং ১৭ শতাংশ অনিশ্চিত রয়েছেন। 'বাংলাদেশ ইন ট্রানজিশন: আ সিটিজেনস কনফিডেন্স সার্ভে ২০২৫' শীর্ষক এ জরিপ অনুযায়ী, জুলাই ২০২৪-এর পর ২৪ শতাংশ পরিবার তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে জানালেও, ৪১ শতাংশ পরিবার ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপে রয়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতি, চাকরির নিরাপত্তা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
জনসাধারণের আস্থা অর্জনে শীর্ষে সশস্ত্র বাহিনী
জরিপে দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থার মাত্রা ভিন্ন। সশস্ত্র বাহিনী (৭২ শতাংশ), নির্বাচন কমিশন (৪৫ শতাংশ) এবং বিচার বিভাগ (৪৬ শতাংশ) তুলনামূলকভাবে বেশি আস্থা অর্জন করেছে। অন্যদিকে, পুলিশের প্রতি ৪২ শতাংশ আস্থা প্রকাশ করলেও ২৭ শতাংশ অবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়েও অনেকেই নেতিবাচক মত দিয়েছেন।
জরিপে জনগণের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জুলাইয় অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর কতটা আস্থা রাখেন। উত্তর হিসেবে 'অনেক বেশি আস্থা' থেকে 'কোনো মতামত নেই' পর্যন্ত অপশন দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা প্রকাশকারীর সংখ্যা সশস্ত্র বাহিনীর তুলনায় অনেক কম।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ৫০ শতাংশেরও বেশি উত্তরদাতা সুপ্রিম কোর্ট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনো মতামত দেননি, যা বৃহত্তর স্বচ্ছতা ও জনসম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে 'কোনো মতামত নেই' উত্তরদাতার সংখ্যা প্রায় অর্ধেক, যা এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে নাগরিকদের অস্পষ্টতা বা অনাগ্রহের ইঙ্গিত দিয়েছে।
প্রিন্ট মিডিয়া সর্বোচ্চ পরিমাণে 'কোনো মতামত নেই' প্রতিক্রিয়া পেয়েছে (৫৭ শতাংশ), এরপর যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন।
মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা
গত বছরের তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী নাগরিকের সংখ্যা বাড়লেও, ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। অন্যদিকে ৪১ শতাংশ মূল্য হ্রাসের প্রত্যাশা করছেন।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার নিয়ে আশাবাদী নন বেশিরভাগ উত্তরদাতা। মাত্র এক-পঞ্চমাংশ মনে করেন, পাচার হওয়া অর্থের একটি বড় অংশ দেশে ফেরত আনা সম্ভব।
উত্তরদাতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য যেসব বড় চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে—পণ্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন।
নির্বাচন প্রধান উদ্বেগ নয়
পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পায়নি। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা মনে করেন, নির্বাচন '২০২৫ সালের শেষ নাগাদ' হতে পারে, আর এক-পঞ্চমাংশের ধারণা, সেটি '২০২৬ সালের জুনের পরে' অনুষ্ঠিত হবে। তবে প্রায় এক-চতুর্থাংশ কোনো মতামত দেননি, যা ইঙ্গিত করে যে নির্বাচন তাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় নয়।
তবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার যখনই দায়িত্ব নিক, নাগরিকদের প্রত্যাশা বেশ উঁচু। তাদের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে—মূল্যস্ফীতি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মানোন্নয়ন। পাশাপাশি সরকারি সেবার উন্নতি, বাকস্বাধীনতা রক্ষা, অর্থপাচার প্রতিরোধ, চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদ দমন, মর্যাদাপূর্ণ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মতো বিষয়গুলোও নিয়ে তাদের উঁচু প্রত্যাশা রয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনির মধ্যেই নতুন বছরে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করতে ২০২৫ সালের ২ থেকে ২৫ জানুয়ারি এ জরিপ পরিচালিত হয়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদ
জুলাইয় অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট সুযোগ সম্পর্কে মতামত জানতে চাওয়া হলে উত্তরদাতারা দুর্নীতি দমন, শিক্ষা উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়ে আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তবে উন্নত রাজনৈতিক পরিবেশ, বৈষম্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির বিষয়ে তুলনামূলক কম আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছেন।
দেশের আটটি প্রশাসনিক বিভাগের ৯৭৩ জন নাগরিকের ওপর পরিচালিত মোবাইল ফোন জরিপটি জনগণের মনোভাব ও প্রত্যাশার একটি চিত্র তুলে ধরে। এটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের প্রভাব কীভাবে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে পুনর্গঠিত করছে, সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
জরিপে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নাগরিকদের আস্থা, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শাসনব্যবস্থ, সংস্কার, নির্বাচনের সময়সীমা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাসংক্রান্ত [থিমেটিক] প্রশ্নও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের নীতিগত অগ্রাধিকার নিয়েও বিশ্লেষণ করা হয়।
পরিসংখ্যানগতভাবে প্রতিনিধিত্বশীল নমুনা নিশ্চিত করতে জরিপে উত্তরদাতাদের বয়স, লিঙ্গ, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং নগর-গ্রাম বিভাজনের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা হয়।
ডেটাসেন্স-টিবিএস পরিচালিত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিয়ে আশাবাদ থাকলেও বাংলাদেশ এখনো বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জরিপের তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা পুনর্গঠন এবং স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা—দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
জরিপ পরিচালনাকারী ওয়াসেল বিন শাদাত বলেন, 'বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ জরিপের ফলাফল নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে, যাতে তারা জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম সামঞ্জস্য করতে পারেন।'
ডেটাসেন্সের প্রধান ইমেজিনেটর অনন্যা রায়হানের তত্ত্বাবধানে জরিপটি পরিচালিত হয়। গবেষণা দলে ছিলেন সাদিক মাহমুদ ও মুনজেলিন সারওয়ার।