যে কারণে কানাডায় ঢুকতে পারলেন না মুরাদ
বিদায়ী তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে কানাডায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। দেশটিতে প্রবেশে তাকে বাধা দেয় কানাডার বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি (সিবিএসএ)।
কানাডার বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, টরন্টো পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদের পর মুরাদকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। মুরাদ ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় কানাডায় একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সে সময় তিনি কানাডার ভিসা নেন। সরকারিভাবেই তার সফর চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সফরে যাওয়ার আগেই তার দপ্তর বদল হয়ে যায়। তিনি তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপরও তিনি কানাডায় স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভার সদস্যদের দীর্ঘমেয়াদী 'মাল্টিপল এন্ট্রি' ভিসা দেওয়া হয়। এটা সাধারণত পাঁচ বছরের জন্য হয়ে থাকে। প্রতিমন্ত্রী মুরাদও দীর্ঘমেয়াদী ভিসা পেয়েছিলেন। ৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর তিনি কানাডায় নতুন করে কোনো ভিসার আবেদন করেননি। ফলে আগের যে ভিসা তার পাসপোর্টে আছে তা ব্যবহার করেই তিনি কানাডায় গেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি এখনো 'কূটনৈতিক পাসপোর্ট' প্রাপ্য।
কিন্তু তাহলে ভিসা থাকার পরেও কেন কানাডায় ঢুকতে পারেননি ডা. মুরাদ হাসান!
ইমিগ্রেশন আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আজামালুল হোসেন কিউসি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কানাডা এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সে দেশের সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্টরা নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এজন্যই বিশ্বের সুন্দর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কানাডা অন্যতম।
যখন কোনো বিদেশি নাগরিক সে দেশে সফর, পড়াশুনা বা কর্মসংস্থানের জন্য প্রবেশ করে, তার প্রতি কানাডার বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি (সিবিএসএ) কঠোর নজরদারি রাখে। এক্ষেত্রে দুইটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেয় সিবিএসএ।
ওই বিদেশি নাগরিকের প্রবেশের কারণে যদি কানাডা তথা কানাডায় বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং তার দ্বারা কোনো সহিংসতা তৈরির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সিবিএসএ ওই বিদেশি নাগরিককে কোনোভাবেই দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয় না।"
এই আইন বিশেষজ্ঞ জানান, এমনকি কানাডার কোনো নাগরিকের অন্য কোনো দেশে সফর, পড়াশুনা বা কাজের জন্য অবস্থানকালে এরকম নিরাপত্তা ও সহিংসতা তৈরির অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধেও এরকম অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আছে।
আজামালুল হোসেন কিউসি জানান, ২০১৬ সালে একজন কানাডিয়ান নাগরিক দক্ষিণ অফ্রিকার একটি দেশে এক নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় অভিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি পালিয়ে কানাডায় প্রবেশের চেষ্টা করেন। কিন্তু সিবিএসএ তাকে কানাডায় ঢুকতেই দেয়নি।
তাকে বিমানবন্দরে আটকের পর দক্ষিণ আফ্রিকার দেশটির সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে, তাকে আবার সেখানে ফেরত পাঠায় তার বিরুদ্ধে আইন ব্যবস্থা নিতে।
ডা. মুরাদ হাসানের বিষয়ে আজামালুল হোসেন কিউসি বলেন, "তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করেছে। ফলে তাকে কানাডার সিবিএসএ দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি বলে গণমাধ্যমগুলো বলছে।"
"এটি আমার কাছেও যৌক্তিক মনে হয়েছে।"
"তবে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ ছাড়াও কোভিড চলাকালীন সময়ে যেসব নিয়ম-বিধি মেনে চলার কথা, সেখানে ডা. মুরাদ হাসানের ব্যত্যয় ঘটেছে বলেও আমি শুনেছি,' যোগ করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ।
কানাডা প্রবাসী এবং কানাডীয় একটি ইমিগ্রেশন কনসাল্টিং কোম্পানির কর্ণধার এম এল গনির সম্প্রতি প্রকাশিত একটি লেখা থেকেও জানা যায়, কোনো ব্যক্তির কানাডায় ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস যাই হোক, সিবিএসএ তাকে কানাডার পয়েন্ট অব এন্ট্রিতে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে।
"কোন বিদেশি নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা (পিআর) বিভিন্ন কারণে কানাডায় প্রবেশের অনুপযোগী বিবেচিত হতে পারেন; যেমন- তিনি যদি কানাডার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বিবেচিত হন এবং তার যদি সহিংস কাজে জড়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে কানাডার জনগণের জীবন বা নিরাপত্তাকে বিপন্ন করার আশঙ্কা থাকে।"
এম এল গনি লিখেছেন, "সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের ক্ষেত্রে যে অডিও ফাঁসের খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে তা সত্য ধরে নিলে তাকে উপরের দুইটি কারণেই অভিযুক্ত করা যায়। বাংলাদেশের এক চিত্রনায়িকাকে তিনি যেভাবে হুমকি দিয়েছেন বলে অডিও ভাইরালে শোনা গেছে, তা যেহেতু ওই চিত্রনায়িকার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক, একই কারণে তা যে কোন কানাডিয়ান নাগরিকের জন্যও বিপজ্জনক গণ্য করা যায়।"
"তাছাড়া, যৌনক্রিয়ার আহ্বানে ওই নারীর অসম্মতিও ফোনালাপে স্পষ্ট। তাই, এটি সম্ভাব্য ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে, যা সহিংসতা। তাকে কানাডায় প্রবেশের সুযোগ দিলে অনুরূপ যৌন সহিংসতা কানাডার জনগণের জীবন বা নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
অন্য একটি অডিওতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর এক নাতনির বিষয়ে 'ব্রিটেনে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সাথে যৌনক্রিয়া করছেন' মর্মে জনাব হাসান যেভাবে সমালোচনা করেছেন, তাতে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রতি তার বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। কানাডা একটি বহুসংস্কৃতির দেশ। ফলে, এমন ব্যক্তি কানাডায় প্রবেশ করা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যও বিপজ্জনক। অডিও রেকর্ড সত্য ধরে নিলে এগুলোর সবকটিই গুরুতর অভিযোগ। এসব বিবেচনায় মুরাদ হাসান কানাডায় 'অপ্রবেশযোগ্য' বিবেচিত না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক।"
মানবাধিকার আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন ফোনালাপে টিবিএসকে বলেন, 'যদি আমরা দেশের সুনামের কথা ভাবি তবে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি, একজন সাংসদ এবং একজন সাবেক মন্ত্রী হয়ে তাকে কানাডায় ঢুকতে না দেয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি খারাপ বার্তা।"
"কিন্তু তাকে কানাডা থেকে ফিরিয়ে দেয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তার নারীবিদ্বেষী হুমকি আর মন্তব্যগুলোর জন্য তার নিজের রাষ্ট্র যে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সে বিষয়টি। আমি মনে করি, এটা আমাদের দেশের জন্য অপমানের এবং বহির্বিশ্বের কাছেও খারাপ বার্তাবাহী।"
সম্প্রতি বিএনপি নেতা তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে ডা. মুরাদ হাসানের দেওয়া 'অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ' বক্তব্যের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপর ফাঁস হয় ঢাকাই সিনেমার একজন নায়িকাকে 'ধর্ষণ' এর হুমকি দেওয়ার একটি অডিও ক্লিপ। এরমধ্যে আরেকটি অনলাইন টকশোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নারী নেত্রীদের নিয়েও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতে দেখা যায় মুরাদকে।
তার এসব বক্তব্যের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিলেন নারী অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। খোদ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্য থেকেও মুরাদ হাসানকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি উঠেছিল।
এসব বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য গত ৬ ডিসেম্বর ডা. মুরাদ হাসানকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ৭ ডিসেম্বর 'ব্যক্তিগত কারণ' দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন মুরাদ।
পদত্যাগের পর একটি ফেসবুক পোস্টে নারীদের উদ্দেশে ক্ষমা চান তিনি। সেখানে লেখেন, "আমি যদি কোন ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।"