মন্ত্রীত্ব হারানো মুরাদের অপমানে সাধারণ মানুষ খুশি কেন?
মন্ত্রীত্ব হারানো এমপি মুরাদ হাসান নিজের দেশ থেকে উড়ে গিয়ে অন্যদেশে জুড়ে বসা দূরে থাক, ঢুকতেই পারেননি। বরং প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্লেনে প্লেনে উড়ে উড়ে ফিরে এসেছেন দেশে। এই খবরটা বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে ব্যাপক 'সুখ' দিয়েছে, সন্দেহ নাই। অন্যভাবে দেখলে যে কেউ স্বীকার করবেন যে, ব্যক্তি মুরাদের জন্য ঘটনাটা কিন্তু ভীষণভাবে অপমানজনক। এটা তো সত্য যে, অন্যের নাজুক অবস্থায়, বিপদে, অসহায়ত্বে মানুষ সাধারণত দুঃখ প্রকাশ করে, সহমর্মিতা জানায়। কিন্তু একজন সাবেক মন্ত্রীর অপমানে সাধারণ মানুষ কেন খুশি হচ্ছেন?
রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের বচন, কর্তাব্যক্তিদের বানানো 'বৈষম্যপূর্ণ সিস্টেম', আইন, শাসন দেশের নাগরিকদের প্রতিটা পদে পদে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে অপমানিত করে যাচ্ছে। তাঁদের ন্যূনতম নাগরিক মর্যাদা পাওয়ার অধিকার হয়েছে বিনষ্ট। একটা রাষ্ট্র যেভাবে চলার কথা- সেখানে আমাদের এই রাষ্ট্রে নাগরিকদের কোনো মতামতকে গ্রাহ্য করা হয় না। জনগণের জনপ্রতিনিধি কে হবেন, তা জনগণও জানেন না! আইনের কাগজে আছে- মতামত দেয়ার অধিকার, পছন্দ করার অধিকার, এমনকি খারিজ করার অধিকার, কিংবা নিজেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনগণের সামনে নিজেকে তুলে ধরার অধিকার... ইত্যাদি আমাদের দেশের মানুষের জন্য অবারিত, কিন্তু বাস্তবে নাই। গণতন্ত্রের সবচেয়ে ন্যূনতম সিঁড়ি হলো- ভোটাধিকার। একজন মানুষ যদি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তার নিজের মতামত দিতে না পারেন, এরচেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে! মুরাদ হাসানের বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা দেশের জন্য কি ইতিবাচক বার্তা দিলো?
একজন নারীকে ধর্ষনের হুমকি দেয়া, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেয়া, বিএনপি'র নেতা-নেত্রী-পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে অত্যন্ত জঘন্য আক্রমণের জন্য মুরাদ হাসান মন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছেন। মনে করার কারণ নেই যে, রাষ্ট্রের প্রধান কর্তারা তাঁদের 'শুভবুদ্ধি'র প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজে থেকেই রাতারাতি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভুলে গেলে চলবে না যে, মুরাদ হাসান নিজে প্রকাশ্যে বলেছেন- তিনি যা করেন, বলেন তা সবই প্রধানমন্ত্রী জানেন। অর্থাৎ মুরাদ হাসান রাষ্ট্রের কর্তাদের মদদপুষ্টই ছিলেন। মুরাদ হাসান তার অনেক বক্তব্যেই প্রধানমন্ত্রীকে 'মা' হিসেবে জাহির করেছে, নেতা-কর্মীদের মুখ থেকে তার কথার সমর্থন আদায় করেছেন। তিনি এটাও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বললে তিনি নিজের জীবনও দিতে পারেন। ফলে তার এসব কর্মকাণ্ডের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপর দায় বর্তাবেই। কিন্তু মুরাদ কখনো এমনটা বলেছেন কিনা জানি না (কেউ জানলে জানাবেন প্লিজ) যে, 'জনগণের জন্য আমি যা প্রয়োজন তাই করতে পারি'। ফলে, এতো 'কাছের' মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী কেন পদত্যাগ করতে বললেন? অনেকে বলতে পারেন, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার-স্যাপারের কারণে ঘটেছে। কিন্তু এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, জনগণের মধ্য থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, এমনকি সরকারি দলের লোকজনের মধ্যেও।
এই প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ার ইতিবাচক দিক হলো- জনগণ আরো একবার বুঝতে পেরেছে যে, মানুষের ক্ষোভ-প্রতিবাদ-ঘৃণা, এগুলোকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা হয়তো এখনো এই সরকার অর্জন করতে পারেনি। মানুষ আরো একবার শক্তি পেয়েছে, অনুভব করেছে 'ঘৃণা-ক্ষোভ-প্রতিবাদের শক্তি' এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। জনগণ আরো একবার বুঝতে পেরেছে, ক্ষমতা যাদের ওপর প্রয়োগ করা হয় তাঁদেরও ভাষা আছে!
খুব খেয়াল করা দরকার- সাবেক মন্ত্রী মুরাদ হাসান কিন্তু তিনজন নারীকে টার্গেট করে তার নোংরা ভাষা প্রয়োগ করেছেন, খালেদা জিয়া, জাইমা রহমান, মাহিয়া মাহি। এই প্রবণতা হলো- ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। ফ্যাসিবাদ নারীকেই তার আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু বানায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনে দেখা যাবে নারীর ওপর আক্রমণ সাধারণ ঘটনা। এক্ষেত্রেও বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে মুরাদ হাসান তাই করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীরা যত দ্রুত এটা বুঝতে পারবেন ততই দেশের জন্য তা ইতিবাচক ফলাফল দিবে। এবারের ঘটনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী, এমনকি নারী সংগঠনও প্রতিবাদ করেছে, যা খুবই ইতিবাচক।
আরো একটা আশা জাগানিয়া বিষয় হলো- মুরাদ হাসান কানাডায় প্রবেশ করতে চাইলে সেদেশে বসবাসকারী বাঙালীদের প্রতিবাদ ও ধিক্কারের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করার ক্ষেত্রে সরকার যতই 'সফল' হোক, বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা বাংলাদেশী ঠিকই দেশের পাশে দাঁড়াতে ও সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে ভুল করেননি। সরকার যতই মনে করুক- দেশের মানুষকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রেখে ক্ষমতা ধরে রেখে লুটপাট চালিয়ে যাবে, কিন্তু সরকারকে এবার আমাদের প্রবাসী বন্ধুরা মনে করে দিয়েছে- তাঁদের অস্তিত্বের কথা। কানাডার 'বেগমপাড়া'র নাম আমরা অনেকেই জানি, জানি মালয়েশিয়ার 'সেকেন্ড হোমের' কথা। বাংলাদেশে লুটপাট চালিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের কথাও এখন দেশের সবাই জানেন। মুরাদকে কানাডায় প্রবল প্রতিরোধের মুখে রাখা নিশ্চয়ই বিদেশে অবস্থানকারী আমাদের প্রবাসীদের 'লুটপাট বিরোধী' লড়াইকে আরো শক্তি দিবে। আগামীতে হয়তো বেগমপাড়ার 'নাই হয়ে যাওয়া'র অন্য গল্প আমরা শুনতে পারবো।
এখানে আরো একটা বার্তা খুবই জরুরিভাবে ভাবনায় রাখা দরকার- কানাডার সরকার তাদের নাগরিকদের আপত্তিকে কতটা গুরুত্ব দেয়! সেই আপত্তি যদি অন্যদেশের বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিকও হয়। কানাডায় প্রবেশের ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো অনুসরণ করা হয় তাতেও মুরাদ হাসান আটকে গিয়েছেন। কানাডার আইনে বলা আছে, কোন বিদেশী নাগরিক যদি কানাডার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বিবেচিত হন ও তার যদি সহিংস কাজে জড়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে কানাডার জনগণের জীবন বা নিরাপত্তাকে বিপন্ন করার আশঙ্কা থাকে তাহলে তিনি প্রবেশাধিকার পাবেন না। মুরাদ হাসানের ক্ষেত্রে যে অডিও 'ফাঁস' হয়েছে তার ভিত্তিতেই তাকে উক্ত আইনের মাধম্যে অভিযুক্ত করা যায়। বাংলাদেশের একজন চিত্রনায়িকাকে মুরাদ হাসান যেভাবে ফাঁস হওয়া ফোনালাপে হুমকি দিয়েছেন, তা যেহেতু ওই চিত্রনায়িকার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক, একই কারণে তা যেকোন কানাডিয়ান নাগরিকের জন্যও বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করা যায়। তাছাড়া, ধর্ষণের হুমকি স্পষ্টতই সহিংস কর্মকাণ্ড। ফলে মুরাদ হাসানকে কানাডায় প্রবেশের সুযোগ দিলে একই রকম সহিংসতা কানাডার জনগণের জীবনকেও বিপন্ন করতে পারে। জাইমা রহমানকে নিয়েও মুরাদ হাসান যা বলেছে তা- একই সাথে অশ্লীল, বিদ্বেষপূর্ণ ও বর্ণবাদী। সেক্ষেত্রেও তিনি কানাডায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন না।
পরিশেষে বলি- মুরাদ হাসানের মন্ত্রীত্ব হারানোর মধ্য দিয়ে এই অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার হয়তো কোন বিশেষ কিছু হয়নি, বড় ধরনের কোন বিপত্তি ঘটেনি। এমনকি এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, দ্রুততার সাথে মুরাদের ওপর অ্যাকশন নিলেও আরো আরো অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন-অগণতান্ত্রিকতা কিন্তু ন্যায্য হয়ে যায় না। যেমন, যে ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁসের মাধ্যমে জনগণ মুরাদের নোংরামির কথা জেনেছে, ঠিক একই রকম নোংরা ও সহিংস কাজ হচ্ছে- ফোনালাপ ফাঁস করা। সুখের অনুভূতিকে পাত্তা দিতে গিয়ে কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিনষ্ট না হোক- এটাও একইভাবে জনগণকে দাবি আকারে রাখতে হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক কর্মী