২৫৯ কন্টেইনার বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্য নিয়ে ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে পড়ে থাকা ২৫৯ কন্টেইনার বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। নিলামে বিক্রি কিংবা ধ্বংস করার জন্য পণ্যগুলো বুঝিয়ে দিলেও বন্দর ইয়ার্ড থেকে সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছেনা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ।
এই বিপজ্জনক পণ্য পড়ে থাকায় বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সাথে বন্দরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এরই মধ্যে গত বছরের ১১ নভেম্বর বন্দরের পি শেডে পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্যের মধ্যে একটি অগ্নিকাণ্ডও সংঘটিত হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৯টি ইয়ার্ডে ২৫৯ টিইইউস (টুয়েন্টি ফুট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট) বিপজ্জনক পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালের পণ্যও রয়েছে। বিপজ্জনক পণ্যের তালিকায় রয়েছে সালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, সালফিউরিক এসিড, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, থিনার, সোডিয়াম সালফেট, মিথানল, ইথাইল হেক্সানল, নাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড সহ বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বছরের পর বছর এভাবে রাসায়নিক পণ্য পড়ে থাকায় বড় ধরনের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। লেবাননের বৈরুত বন্দরের পুনরাবৃত্তি যেন চট্টগ্রাম বন্দরে না ঘটে সেই লক্ষ্যে এসব পণ্যের দ্রুত বন্দর ইয়ার্ড থেকে অপসারণ চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে একাধিক চিঠি দিলেও সাড়া পাচ্ছে না বন্দর। গত বছরের ১৫ মার্চ বন্দর চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার যৌথভাবে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে কাস্টমসের পুরাতন নিলাম গোলা থেকে পণ্য সরিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তরের কথা বলা হয়। কিন্তু ১ বছরেও সেটি সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী দ্য বিজনেস স্ট্যন্ডার্ডকে বলেন, 'যে কোন ধরনের ক্যামিকেল, রাসায়নিক ও বিপজ্জনক পণ্য আলাদা আলাদা স্থানে রাখা প্রয়োজন। এসব বিপজ্জনক পণ্য বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন তাপমাত্রায় একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা হলে সেগুলো পরিবেশ, প্রতিবেশ, পানি, বাতাস সর্বোপরী মানুষের জীবনবিনাশী হয়ে উঠে। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোন অবস্থাতেই এসব বিপজ্জনক পণ্য দীর্ঘদিন মজুদ করে রাখা ঠিক হয়নি'।
এদিকে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বিপজ্জনক পণ্য ও পণ্যবাহী কন্টেইনার অপসারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছেন।
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নিলামের জন্য পণ্য শুল্ক বিভাগকে হস্তান্তর করা হলেও বাস্তবে নিলামযোগ্য পণ্য বন্দর অভ্যন্তরে থেকে যায়। এতে বন্দরে পণ্যজট সৃষ্টি হয় এবং স্বাভাবিক অপারেশন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নয়কে বাধাগ্রস্ত করে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেডে নিলামযোগ্য প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন পণ্য এবং বিভিন্ন ইয়ার্ডে প্রায় ৬ হাজার টিইইউস কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ পণ্য এবং কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক অপারেশনাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব পণ্যের মধ্যে বিপজ্জনক পণ্য ও পণ্যবাহী কন্টেইনারও রয়েছে। এই বিপজ্জনক পণ্য এবং কন্টেইনারসমূহ একদিকে যেমন বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনি বন্দরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, নিলামযোগ্য কন্টেইনার এবং পণ্য সংরক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব স্থান ও অর্থে শুল্ক বিভাগকে একটি নিলাম গোলা নির্মাণ করে দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে শুল্ক বিভাগ নবনির্মিত গোলায় তাদের কার্যক্রম শিফট না করে বন্দর অভ্যন্তরে পুরাতন নিলাম গোলা ব্যবহার করে আসছে। এতে বন্দর অভ্যন্তরে নিলাম গোলা হিসাবে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ স্থান অব্যবহৃত রয়েছে।
প্রতি মাসে ন্যূনতম ৪ থেকে ৫টি ই-অকশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিপজ্জনক পণ্যের নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয় ও চিঠিতে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক বলেন, 'বন্দর থেকে বিপজ্জনক এবং নিলামযোগ্য পণ্য সরানোর দায়িত্ব কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। এসব প্রক্রিয়ায় কাস্টমসের সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতাও রয়েছে। যত দ্রুত বন্দর থেকে এসব পণ্য সরানো যাবে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম আরো সহজ হবে'।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের পি শেডে ধ্বংসযোগ্য প্রায় ৪৯ মেট্রিক টন পণ্য ধ্বংস করা হয়েছে। আরো প্রায় ১০ মেট্রিক টন পণ্য ধ্বংসের জন্য সুনামগঞ্জের লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লি্মিটেডের কারখানায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, 'সীমিত জনবল দিয়ে ৪০ বছরের পুরোনা পণ্য অপসারণ সহজেই সম্ভব নয়। এরপরও আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। বন্দর থেকে পুরাতন অকশন গোলা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলমান রয়েছে'।