‘গরিবের বাজার’ এখন আর গরিবের না
দুপুরের রান্নার জন্য গুঁড়া মরিচ ও চাল কিনতে সকাল ১০টার দিকে 'গরিবের বাজারে' আসেন নুরুন্নাহার। কিন্তু যে দোকানটিতে ৩০ টাকা কেজির চাল বিক্রি হয়, সেই দোকানটি বন্ধ। অন্য দুটি দোকানে মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা। কিন্তু এত দামে চাল কেনার টাকা না থাকায় তিনি শুধু ১০ টাকার গুঁড়া মরিচ কিনেই ফিরে যান।
গৃহকর্মী নুরুন্নাহার টিবিএসকে বলেন, '৩০ টাকা চাল বিক্রির দোকানটি বন্ধ থাকায় চাল কিনতে পারি নাই। এখন প্রতিবেশি কারও কাছ থেকে একটু চাল ধার করে রান্না করতে হবে।'
বিজয় সরণি তেজগাঁওয়ের তেজকুনি পাড়ার উড়াল সড়কের নিচে রেললাইনের পাশের বাজারটি গরিবের 'বাজার নামে' পরিচিত। এখানে রিকশাচালক, দোকান কর্মী, বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক, গৃহকর্মীসহ নিম্ন আয়ের মানুষগুলোই এই বাজারের ক্রেতা।
নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর জন্য দোকানগুলোতেও অন্য বাজারের তুলনায় কিছুটা সস্তায় পণ্য পাওয়া যেত। বিশেষ করে দু-তিনটি দোকানে তেল, ডাল, হলুদ-মরিচের গুঁড়াসহ বিভিন্ন পণ্য ছোট ছোট প্যাকেট করে বিক্রি করা হয়।
তবে চাল, গম, তেল, আটা, ময়দাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে এই বাজারেও। এখানেও সব জিনিসের দাম বেড়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, ২০ টাকা করে পলিব্যগের মধ্যে সয়াবিন তেল রাখা হয়েছে। আগে ১০ টাকার তেল কেনা যেত, এখন দাম বাড়ায় তেলের প্যাকেট কিনতে হচ্ছে ২০ টাকায়। বাজারটিতে ৫-১০ টাকার সবজিও বিক্রি হয়। কেউ ৫ টাকার বরবটি, একটু ভাঙা বেগুন এসব বেছে বেছে কিনতে দেখা গেছে।
নুরুন্নাহার জানান, দুটি বাসায় কাজ করে প্রতি মাসে তার আয় ৫ হাজার টাকা। গ্রামে থাকা দুই সন্তানের পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ বাবদ ১৫০০ টাকা করে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এখন সবকিছুর খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়িতে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তেলের দাম বাড়ার পর থেকেই তিনি নিয়মিত তেল ছাড়া রান্না শুরু করেছেন।
মাস ছয়েক আগে বাসা বাড়িতে কাজ করলেও এখন ছোট সন্তানের জন্য কাজ করতে পারছেন না কুলসুম বেগম। স্বামী সিএনজি চালিয়ে যা আয় করেন তাতেই নিজের সংসার খরচ, শ্বশুরবাড়িতেও খরচ পাঠাতে হয়।
কুলসুম বেগমও এসেছিলেন ৩০ টাকা কেজির চাল কেনার আশায়। দোকান বন্ধ পেয়ে তিনি ১০ টাকার হলুদ ও ৫০ টাকা দিয়ে এক কেজি চাল কিনেছেন। দোকান খুললে একসঙ্গে ৫ কেজি চাল কিনবেন বলে জানালেন।
কুলসুম বলেন, ৫ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দেওয়ার পর যে টাকা থাকে সেই টাকা দিয়ে কোনো মতে খেয়ে বেঁচে আছি। এক বছর বয়সী ছেলেকে দুধ-ডিম খাওয়ানো দরকার হলেও অতিরিক্ত খরচের কারণে বাড়তি খাবার দিতে পারি না।
১০, ২০ টাকার পণ্যের প্যাকেট বিক্রি করছেন বিক্রেতা তাসলিমা আক্তার। তিনি বলেন, অনেকেই এসে ১০ টাকার তেল চাচ্ছেন। কিন্তু ২০০ টাকা দাম হওয়ার পর আর ১০ টাকার প্যাকেট করা যায় না।
তিনি জানান ডালসহ বিভিন্ন মশলার দাম বৃদ্ধির কারণে প্যাকেটের দাম ১০ টাকা রাখলেও পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। না হলে লাভ থাকে না।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন মনির হোসেন। তিনি পরিবার নিয়ে বস্তির একটি টিনশেডে ৩ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়া থাকেন। দুই সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তার বসবাস। যা আয় তা দিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আগে মাসে দুদিন মুরগি কিনতাম, এখন সেটা একদিনে এনেছি।
মুরগি বিক্রেতা সুলতানা বেগম বলেন, ৮ বছর ধরে ব্যবসা করি এই বাজারে। এমন সংকট কখনও দেখিনি। বিক্রি কমে গেছে। মুরগির দাম ১৬০ টাকা কেজি হলেও এটা রান্না করতেতো তেলসহ মশলা লাগে। এই জন্য অনেকেই এখন মুরগি কিনছে না। প্রতিদিন ৪-৫ হাজার টাকার মুরগি বিক্রি হলেও এখন সেটা ২-৩ হাজারে নেমে এসেছে।
এই বাজারের মাছ বিক্রেতার মোহম্মদ ফরহাদ বলেন, সিলেটে বন্যা হওয়ার জন্য ছোট মাছ কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে। তার ওপর দ্রব্যমূল্য বাড়ার জন্য বিক্রিও কমে গেছে। তাই আমাদের লাভও কম হচ্ছে। এখানে বেশিরভাগ ক্রেতাই এক পোয়া-আধা কেজি মাছ কিনেন।
মেরুল বাড্ডায় পাঁচতলা বাজার নামে একটি বাজার রয়েছে, যেখানেও নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি সীমিত আয়ের কিছু মধ্যবিত্ত মানুষও সেখান থেকে বাজার করে আসছে। এখানে অন্যান্য বাজারের তুলনায় মুরগির মাংস ১০-১৫ টাকা, মাছের দাম কেজিতে ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত কমে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সবজিতেও ৫- ১০ টাকা কমে পাওয়া যায়।
ঢাকার রামপুরা কাঁচাবাজারে এখন এক কেজি তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকায়। এই বাজারে তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়।
হাবিবুর রহমান নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী বাজার করতে এসে বলেন, বাসার নিচেই সবজি কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু ৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বের এই বাজারে আসলে কেজিতে ৫-১০ টাকা সাশ্রয় হয়। মাছও কিছুটা সস্তায় পাওয়া যায়। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ সমন্বয় করতে এই বাজার থেকেই কিছুদিন ধরে নিয়মিত বাজার করছি।
ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিত্যব্যবহৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে চাপে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষগুলো। প্রতিদিন খাবার কমিয়ে দিয়ে, একটু সস্তার বাজার খুঁজে কেনাকাটা করে কোনোরকমে পরিবার সামলাচ্ছেন।