সত্যি আমি অবৈধ সন্তান: মেরিলিন মনরো
মার্কিন অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো বেঁচে থাকলে ১ জুন ৯৫ বছর পূর্ণ করতেন। মেরিলিন মনরোকে নিয়ে পৃথিবীজুড়ে যত লেখালেখি হয়েছে, যত প্রতিভাধরই হোন না কেন, অন্য কোনো অভিনেতা ও অভিনেত্রী এই সূচকে তার ধারেকাছেও আসতে পারেননি; সেই আলোড়নও কেউ তোলেন নি, বছরের পর বছর ধরে মানুষের অন্তরে এমন স্থায়ী আসনও কেউ দখলে রাখতে পারেন নি।
শতবর্ষের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সৌন্দর্যে, অভিনয়গুণে, গ্ল্যামারে, জীবনের বৈচিত্র্যে আলাদা আলাদাভাবে খ্যাতিমান অনেক নায়িকাই, কিন্তু সব মিলিয়ে অনতিক্রম্য একজনকে যদি খুঁজতে হয়, তিনি অবশ্যই মেরিলিন মনরো। জীবদ্দশায় তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন, অকালমৃত্যুর পর সে আলোচনা কমেনি, বেড়েছে বহুগুণ। আত্মহত্যা না হত্যা-এই বিতর্কের উপসংহার এখনো টানা হয়নি। আগস্ট ৫, ১৯৬২ ব্রেন্টউডের ১২৩০৫ ফিফথ হেলেনা ড্রাইভ-এর বাড়িতে ৩৬ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।
অফুরন্ত জীবন যার হাতের মুঠোয়, সেই মেরিলিন মনরো জন লেননকে মৃত্যুর কিছুদিন আগে লিখেছিলেন, 'আমার ইচ্ছেশক্তি বড় দুর্বল, আমি কোনোকিছুর ওপর দাঁড়াতে পারছি না। আমাকে পাগল মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই আমার অভিনিবেশ এবং আমার শেখার এতদিনকার তাড়না আমাকে ছেড়ে যায়। তখন আমার মনে হয় মানব জাতির মধ্যে আমার যেন আর কোনো অস্তিত্ব নেই'।
'এটা সত্যি কথা আমি অবৈধ সন্তান। তবে আমার বাবা কিংবা বাবাদের নিয়ে যা কথা হয় সবই ভুল। আমার মায়ের প্রথম স্বামীর নাম বেকার, দ্বিতীয়জনের নাম মর্টেনসন। আমার যখন জন্ম আমার মা দুজনেরই কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্ত। আমার নামের সাথে মর্টেনসন থাকার কারণে কেউ কেউ বলেন আমি নরওয়েজিয়ান। আমার জন্মের পরপরই মটর সাইকেল দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। এটা সত্য কিনা আমি জানি না। তবে তিনি কোনোভাবেই আমার অন্তরের ভেতর সম্মানিত কেউ নন।'
'অবৈধ সন্তান হিসেবে আমি যখন জন্মগ্রহণ করেছিই, আমাকে তো একটা নাম দিতে হবে। আমার ধারণা মা তাই তাড়াহুড়ো করে নাম দিয়েছে 'বেকার'। যাই ঘটুক আমার নাম নোরমা জিন বেকার, আমার স্কুলের রেকর্ডে তাই আছে, অন্যরা আজগুবি যা বলছে সব মিথ্যা।
মানুষ যাই বলুক সত্যটা হচ্ছে আমি কখনো মা'র সাথে থাকিনি। আমি থেকেছি অন্য মানুষের সাথে। আমার মা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। মা আর নেই। আমার মা'র বাবা এবং মা-ও মানসিক হাসপাতালে মারা গেছেন। মাকেও ভর্তি করা হয়েছিল। কখনো কখনো হাসপাতাল থেকে বের করা হলেও মাকে বারবার সেখানে ফিরে যেতে হয়েছে।
আমি যখন ছোট ছিলাম কোনো মহিলাকে দেখলে ভাবতাম 'এটা আমার মা', আর কোন পুরুষ মানুষকে দেখলে 'এটা আমার বাবা'।
আমার বয়স যখন তিন বছর তখন এক সকালে যে মহিলা আমাকে গোসল করাচ্ছিলেন তাকে আমি বললাম 'মাম্মি'।
তিনি বললেন আমি তোমার মা নই, আমাকে আন্টি বলবে।
আমি তার স্বামীর দিকে আঙুল তুলে বললাম 'কিন্তু ঐ যে আমার ড্যাডি'। তিনি বললেন, 'না, আমরা তোমার বাবা-মা নই। এখানে লাল চুলের যে নারী আসে সে তোমার মা'।
এটা আমার জন্য খুব বড় আঘাত। কিন্তু ঐ নারীও তেমন আসেন না। আমার কাছে তিনি লালচুলের নারী হয়েই রয়ে গেলেন।
তবে যাই হোক আমি জানতাম আমার মায়ের অস্বিত্ব রয়েছে। আমাকে যখন এতিমখানায় দেয়া হয় আমি আরেকটা আঘাত পাই। তখন আমি পড়তে পারতাম। যখন দেখলাম কালো রঙের পিঠে সোনালী হরফে 'অরফানেজ' লেখা আছে, আর তারা আমাকে জোর করে ভেতরে আনার চেষ্টা করছে, আমি চিৎকার করে উঠি 'আমি এতিম নই আমার মা আছে'।
পরে ভাবলাম 'থাক না। বরং এটাই ভাবি যে আমার মা মৃত।'
অন্যরা আামাকে বলেছে, 'তোমার যে মা আছে এটা ভুলে যাও।'
'কিন্তু মা কোথায়?' আমি জিজ্ঞাসা করি।
তারা বলে, 'এখন এটা ভাববার দরকার নেই। তোমার মা মারা গেছে।'
কিছুদিন পরপর মা হঠাৎ দেখা দেন। এভাবেই বছরের পর বছর চলে। মা নেই এই মিথ্যা কথা বলার জন্য কেউ কেউ আমাকে অভিযুক্ত করে, কারণ তিনি কোথায় ছিলেন আমি তা বলতে চাইনি।
আমি দশটা কিংবা এগারটা পরিবারের সাথে থেকেছি। প্রথম পরিবারটি লস এঞ্জেলসে, সেখানেই আমার জন্ম। আমার সাথে একটা ছোট ছেলেও ছিল, তারা দত্তক নিয়েছিলেন। সাত বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই থাকি। তারা ছিলেন খুব কড়া ধরনের মানুষ।
তারা খুব রূঢ়ভাবে আমাকে লালন করেছেন। আমাকে এমনভাবে সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন যা কখনো উচিৎ নয় বলে আমার ধারণা। তারা আমার ওপর চামড়ার বেল্ট চালাতেন।
শেষ পর্যন্ত আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। আমাকে হলিউডে একটি ইংরেজ দম্পতির কাছে দেয়া হয়। তারা ছিলেন অভিনেতা-অভিনেত্রী, আমার ধারণা সিনেমার 'এক্সট্রা'। তাদের কুড়ি বছর বয়সী মেয়েটি অভিনেত্রী ম্যাডেলেইন ক্যারোলের মতো দেখতে।
তাদের সাথে আমার জীবনটা অন্যরকম, অনানুষ্ঠানিক প্রথম পরিবারটির চেয়ে ভিন্ন ধরনের। প্রথম পরিবারটিতে সিনেমা, গায়ক-গায়িকা, নাচ কিংবা গান নিয়ে কথা বলা যেতো না। হয়তো চার্চের স্তোত্র নিয়ে বলা সম্ভব ছিল।
আমার নতুন বাবা-মা কঠোর পরিশ্রম করতেন। কাজের সময়টাতে কেবলই কাজ, অন্য সময়টা উপভোগ করতেন। তারা নাচ ও গান ভালোবাসতেন, মদ্যপান করতেন, তাস খেলতেন, আর তাদের অনেক বন্ধু ছিল। আগের পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসনে লালিত হবার কারণে আমি এখানে এসে ভীষণ ধাক্কা খেলাম। আমার মনে হলো এরা অবশ্যই দোযখে যাবেন। আমি তাদের মঙ্গলের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা প্রার্থনা করেছি।
আমার মনে পড়ছে আবার আমার মায়ের অভ্যুদয় ঘটে। তিনি একটি ছোট বাড়ি কেনেন, সেখানেই আমাদের থাকার কথা। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে মাকে আবার হাসপাতালে পাঠাতে হয়। মা চলে গেলে আমি আবার হলিউডে ফিরে আসি।
যতোদিন আমার মায়ের টাকা তারা পেয়েছেন, ইংরেজ পরিবারটি আমাকে রেখেছে। তার ইন্সুরেন্স পলিসি থেকেও কিছু টাকা এসেছে। আমার বয়স তখন আটও হয়নি, আমি তাদের মাধ্যমে সিনেমা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি।
তারা আমাকে হলিউডের বড় মুভি থিয়েটারে নিয়ে যেতেন- এটা ইজিপশিয়ান কিংবা গ্রুম্যানস চাইনিজ থিয়েটার। ইজিপশিয়ান থিয়েটারের বাইরে খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আমি একা একা অনেক বানর দেখতাম। গ্রুম্যানস চাইনিজ থিয়েটারের সামনে পায়ের ছাপের ওপর পা রেখে মেলাতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু আমার জুতো অনেক বড় হওয়ায় মিলতো না।
সিনেমা শুরু হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতাম, তারপর দশ সেন্ট দামের টিকিট কিনে সামনের সারিতে গিয়ে বসে পড়তাম। আমি সব ধরনের সিনেমা দেখেছি। ক্লদেত কোলবার্ট অভিনীত ক্লিওপেট্রার কথা বেশ মনে আছে।
আমি সেই থিয়েটারে বারবার সিনেমা দেখেছি। অন্ধকার নেমে আসার আগে আমায় বাসায় পৌঁছতে হতো। কিন্তু অন্ধকার নেমে এসেছে কিনা আমি বুঝবো কেমন করে? আমার জন্য তারা খুব ভালো ছিলেন। যখন খালি পেটে বাড়ি ফিরতাম আমি জানতাম আমার জন্য কোনো না কোনো খাবার থাকবে। কাজেই অন্ধকারের কথা ভুলে আমি সিনেমা দেখতেই থাকতাম।
আমার প্রিয় তারকা জিন হার্লো। আমার প্লাটিনাম ব্লন্ড চুল, লোকজন আমাকে বলতো দুই মাথা। এটা আমি পছন্দ করতাম না। আমি সোনালী চুলের স্বপ্ন দেখতাম। জিন হার্লোকে দেখার পর সব পাল্টে গেল। কত সুন্দর দেখতে, আর আমারই মতো প্লাটিনাম ব্লন্ড চুল তার।
আর ক্লার্ক গ্যাবল, আশা করি তিনি কিছু মনে করবেন না। ফ্রয়েডিয়ান ধারণায় এটা ভুল কিছু না। আমি তাকে ভাবতাম আমার বাবা। আমি ভান করতাম ক্লার্ক গ্যাবল আমার বাবা কিন্তু আমি কখনো এভাবে কাউকে মা মনে করিনি, কেন করিনি জানি না।
মার টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার পর ইংরেজ দম্পতি আমাকে আর রাখতে চাইলেন না কিংবা পারলেন না। তখন আমাকে পাঠানো হলো নর্থ হলিউডে একটি বাড়িতে। তারা নিউ অরলিন্সের মানুষ। সেখানে বেশিদিন থাকা হয়নি- দুই কি তিন মাস। আমার এটুকু মনে আছে, ভদ্রলোক ছিলেন ক্যামেরাম্যান। একদিন হঠাৎ তিনি আবার আমাকে এতিমখানায় নিয়ে এলেন। আমি অনেককে জানি যারা বলেন এতিমখানা তেমন খারাপ নয়। আমি জানি না এখন তেমন বদলে গেছে কিনা, এখন হয়তো আগের মতো বিষন্ন নয়। যত আধুনিকই হোক এটা তো শেষ পর্যন্ত এতিমখানাই।
রাতে অন্যরা যখন ঘুমিয়ে পড়তো আমি জানালায় বসে কাঁদতাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দূরে ছাদের উপর আরকে স্টুডিওর নামটি দেখতে পেতাম। এখানে আমার মা ফিল্ম কাটার কাজ করতেন। কয়েক বছর পর ১৯৫১ সালে আমি যখন সেখানে কাজ করতে যাই, ছাদের উঠে দেখার চেষ্টা করতাম এতিমখানাটি চোখে পড়ে কিনা।
কিন্তু আমার দৃষ্টিপথে অনেক উঁচু উঁচু ভবন।
কোথায় যেন পড়েছি কেউ লিখেছেন আমি এতিমখানায় আরো তিনটি বা চারটি মেয়ের সাথে একটি রুমে থাকতাম। এটা মোটেও সত্যি নয়। আমি যে রুমে থাকতাম সেখানে আমাদের সাতাশজনকে ঘুমোতে হতো।
আর একটি ডর্মিটোরিতে কয়েকটি 'সম্মানজনক' বেড ছিল। এতিমখানায় সদাচারণের কারণে কখনো কাউকে বরাদ্দ করা হতো। আমিও একবার সম্মানিত হয়ে এই বেড পেয়েছিলাম। এক সকালে আমি দেরি করে ফেলেছিলাম। যখন জুতোর ফিতে বাঁধছি, কিন্তু মেট্রন চেঁচিয়ে বললেন, আবার সাতাশ বেডের রুমে চলে যাও।
ছ'টায় ঘুম থেকে উঠে আমাদের সব কাজ শেষ করে পাবলিক স্কুলে যেতে হতো। আমাদের একটি করে বিছানা, একটি চেয়ার ও একটি লকার। সবকিছু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও ফিটফাট রাখতে হবে যেনো যে কোনো সময় পরিদর্শনের জন্য তৈরি থাকে।
আমি যে ডর্মিটরিতে থাকতাম, একসময় এটার মেঝে আমাকেই পরিস্কার করতে হতো। বিছানা সরাও, ঝাড় দাও, ধুলি ঝাড়ো। বাথরুম পরিস্কার করাটা বরং সহজ ছিল, সিমেন্টের মেঝে, কম ধুলি। আমি রান্নাঘরে ধোয়ামোছার কাজ করতাম। একশত এতিমের প্লেট, চামচ, কাটা চামচ; কাটা চামচের সাথে ছুরি কিংবা প্লেটের সাথে গ্লাস আমাদের দেয়া হতো না।
কিচেনে কিছু বাড়তি কামাইয়ের সুযোগ ছিল, মাসে পাঁচ সেন্ট (এক ডলারের কুড়ি ভাগের এক ভাগ)। সানডে স্কুলের জন্য আমাদের এক পেনি করে দিতে হতো। মাসে চারটা রোববার থাকলে এক পেনি বেঁচে যেতো। ক্রিসমাসে বন্ধুকে কিছু একটা কিনে দেয়ার জন্য এই টাকা জমিয়ে রাখতাম।
এতিমখানায় আমি সুখী ছিলাম না। ম্যাট্রন আমাকে পছন্দ করতেন না, আমিও তাকে অপছন্দ করতাম।
কিন্তু সুপারিনটেনডেন্ট ভদ্রমহিলা ছিলেন খুব চমৎকার। একদিন তিনি আমাকে তার অফিসে ডাকিয়ে নিয়ে বললেন, 'তোমার গায়ের চামড়া খুব সুন্দর কিন্তু সবসময় জ্বলজ্বল করে। একটু পাউডার ছড়িয়ে দেখি কাজ হয় কিনা'। আমি খুব সম্মানিত বোধ করলাম। পেকিনিজ নামে তার একটি ছোট কুকুর ছিল, একে বাচ্চাদের কাছে যেতে দেয়া হতো না কারণ কামড়ে দিতে পারে। কিন্তু কুকুরটা আমার সাথে খুব বন্ধুসুলভ ছিল। আমি একে পছন্দ করতাম। আমি খুব সম্মানিত বোধ করেছি।
আমার তখন আর মাটিতে পা পড়ছে না।
পরে আমি একবার কয়েকটি মেয়েকে নিয়ে এতিমখানা থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোথায় যাবো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। কোথায় যাবো এ ব্যাপারে আমাদের সামান্যতম ধারণাও নেই। এতিমখানার সামনের লনের উঁচু জায়গাটা পর্যন্ত যেতে না যেতেই আমরা ধরা পড়ে গেলাম। অমি শুধু এটুকু বলেছিলাম, 'দয়া করে সুপারিনটেনডেন্টকে জানাবেন না'। কারণ তিনি আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। আমার হাতে পাউডার মেখে দিয়েছেন এবং তার কুকুরটাকে আদর করতে দিয়েছেন।
এতিমখানায় আমি তোতলাতে শুরু করি। যেদিন আমাকে এখানে দিয়ে গেল এবং তারা টেনে ভেতরে আনল, আমি চেঁচিয়ে কাঁদতে থাকলাম। সামনেই দেখি একটা বিশাল ডাইনিং রুম, শত শিশু একসাথে খাচ্ছে। তখন পাঁচটা বাজে, তারা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তখনই কান্না থামিয়ে দিলাম।
আমার মা আছেন তারপরও এতিম হয়ে যাওয়া- এই ধারণাটা আমাকে যন্ত্রণা দিতে থাকল। কে জানে, অন্যদেরও হয়তো তাই। সেই প্রথম আমি তোতলাতে শুরু করলাম।
আমি তখন ভ্যান নাইট হাই স্কুলে পড়ি। আমাকে ইংলিশ ক্লাসের সেক্রেটারি করা হলো। যখন আমাকে মিটিং এর কার্যবিবরণী পড়তে হতো, মিটিং বলতে গিয়ে আমি 'মি মি মি মিটিং' বলতাম। দু'বছর আমার এ অবস্থা চলেছে। আমার মনে হয় পনের বছর পর্যন্ত। যখন আমি নার্ভাস বা উত্তেজিত থাকতাম তখনই তোতলাতে শুরু করতাম।
সিনেমায় একটা ছোট চরিত্র পাবার পর কথা বলতেই 'তো তো তো' শুরু হয়ে গেল। এখনো দ্রুত কথা বলতে গেলে কিংবা বক্তৃতা দেয়ার সময় সেই অবস্থাটা ফিরে আসে। কী ভয়ংকর ব্যাপার।
এ দফায় আমি দেড় বছর এতিমখানায়। আমরা পাবলিক স্কুলে যেতাম। একই স্কুলে দু'ধরনের শিশু। একধরনের শিশু বাড়ি থেকে স্কুলে এসেছে আরেক ধরণের শিশু এতিমখানা থেকে স্কুলে এসেছে। এতিমখানা থেকে আসার কারণে আমরা খুব লজ্জিত অবস্থায় থাকতাম।
স্কুলে আমার পছন্দের বিষয় ইংরেজি আর গান গাওয়া। অংকটা ছিল ভীষণ অপছন্দের। আমি কখনো এতে মন বসাতে পারিনি। আমি সব সময় জানালায় বসে স্বপ্ন দেখতাম। আমি কিন্তু স্পোর্টস-এ খুব ভালো ছিলাম।
আমি ছিলাম বেশ লম্বা। প্রথমদিকে এতিমখানায় যখন বললাম আমার বয়স নয় বছর কেউ বিশ্বাস করতো না। তাদের ধারণা আমি চৌদ্দ। আমি এখন যতটা লম্বা তখনও ঠিক সমান সমানই ছিলাম- পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। এগার বছর বয়স পর্যন্ত আমি ছিলাম অত্যন্ত সরু। তারপর সব বদলাতে শুরু করলো।
তখন আমি আর এতিমখানায় থাকছি না। আমার মায়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবি গ্রেইস ম্যাককিকে এতিমখানার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছি যে তিনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান।
তিনি আমার আইনি অভিভাবক। তখন তিনি কলম্বিয়ায় ফিল্ম এডিটর হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু তার চাকরি চলে যায়। তিনি তার চেয়ে দশ বছরের ছোট তিন সন্তানের বাবাকে বিয়ে করেন। তারা ছিলেন গরীব, আমাকে লালন-পালন করা আর সম্ভব ছিল না। তিনি নিশ্চয়ই অনুভব করলেন তার স্বামী ও সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব আমার চেয়ে বেশি।
তবে এটা ঠিক তিনি ছিলেন আমার প্রতি অসম্ভব সদয়। তাকে না পেলে আমি যে কোথায় গিয়ে পৌঁছাতাম কে জানে! হয়তো আঠারো বছর পর্যন্ত আমার জীবন এতিমখানায় কাটতো।
[মেরিলিন মায়ের বান্ধবীর তুলনামূলক কম বয়সী স্বামীর যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এ বাড়ি ও বাড়ি করে তাকে আবার এতিমখানায় আসতে হয়। বিভিন্ন বাড়িতে তিনি শিশুদের দেখেছেন- এটা খাবে না, ওটা খাবে না। কিন্তু তার কোনোটাতেই না নেই। যা দেয় তাই খান, যে কোনো কিছু, তার কোনো অভিযোগ নেই। তার প্রিয় সঙ্গী ইমাজিনেশন বা কল্পনা। তিনি কল্পনা করতে ভালোবাসেন, স্বপ্ন দেখে আনন্দিত হন। অন্য শিশুরা তার সাথে খেলতে পছন্দ করে কারণ মেরিলিন অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা আবিষ্কার করতেন-চলো, খুন করার খেলা খেলি কিংবা চলো তালাক দেবার খেলাটা খেলি।
শিশুরা অবাক হতো! এসব তার মাথায় কোথা থেকে আসে। স্কুলের নাটকে নারী ও পুরুষ দুই চরিত্রেই তিনি অভিনয় করেছেন। লম্বা হবার কারঞে একবার রাজার চরিত্রে আবার রাজকুমারের চরিত্রে।]
আমি যখন বড় হচ্ছিলাম আমার সবচেয়ে সুখের সময় কেটেছে আন্ট আনার বাড়িতে। তিনি গ্রেইস ম্যাককির মা। অনেক বয়স্ক, আমার ধারণা ষাটের কাছাকাছি। তার বয়স যখন কুড়ি বছর তিনি সবসময় সেই বয়সের কথা বলতেন। আমাদের দু'জনের মধ্যে সত্যিকারের সংযোগ স্থাপিত হয়, যেকোনোভাবেই হোক তিনি আমাকে বুঝতেন।
তিনি জানতেন তারুণ্য কেমন। আমি অন্তর দিয়ে তাকে ভালোবাসতাম। সন্ধ্যার সময় আমি যখন ধোয়ামোছার কাজ করতাম, আমি সারাক্ষণ গান গাইতাম আর শিস দিতাম। তিনি বলতেন, আমি এমন বাচ্চা মেয়েকে কখনো এভাবে গান গাইতে শুনিনি।
আমি যখনই পনের থেকে ষোলতে পড়লাম গ্রেইস ম্যাককি আইনি অভিভাবক হিসেবে আমার বিয়ে ঠিক করলেন। বিয়ে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। গ্রেইস তার স্বামীর সাথে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া চলে যাবেন। এখানে আমার জন্য তারা লস এঞ্জেলেস কাউন্টি থেকে কুড়ি ডলার করে পেতেন। আমি তাদের সাথে গেলে এ টাকা তারা পাবেন না।
আমাকে লালন-পালন করাও তাদের পক্ষে সম্ভব না। কাজেই বিয়েটাই উত্তম। ক্যালিফোর্নিয়ার আইনে ষোল বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে হতে পারে। আমার সামনে তখন দুটো পথ- এতিমখানায় ফিরে গিয়ে আরও দু'বছর কাটিয়ে আঠারো হবার জন্য অপেক্ষা করা অথবা এখনই বিয়েতে রাজি হওয়া। আমি এতিমখানায় ফিরে যেতে চাই না। রাজি হয়ে গেলাম।
তার নাম ডোগার্টি। তখন তার বয়স একুশ বছর। সে একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। যুদ্ধ এসে গেল। তাকে বাধ্যতামূলকভাবে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিতে হলো। সে গেলো মার্চেন্ট মেরিন জাহাজে, আমি তার সাথে কাটালিনাতে কিছু সময় কাটাই। সেখানে তাকে শরীর চর্চার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসছে ডোগার্টিকে তালাক দেয়ার জন্য আমি লাস ভেগাসে যাই।