ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত কখন, কীভাবে শেষ হতে পারে?
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি বলেন, 'যুদ্ধ জয় হবে যুদ্ধক্ষেত্রে, কিন্তু শেষ হবে সমঝোতার ভিত্তিতেই'। কথাটা একটু স্ববিরোধী শোনা যাচ্ছে বটে! কখন, কোন শর্তে যুদ্ধ শেষ হবে, তা কি জেলেনস্কি জানেন? সম্ভবত এখনও না।
পশ্চিমারা বলছে, এটা ইউক্রেনেরই সিদ্ধান্ত। এমনটা বলার পেছনে একটা কারণ বলা হয় যে- যুদ্ধের তিন মাস পরও পশ্চিমা দেশগুলি এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় তাদের অবস্থান ঠিক কোন দিকে হবে- তা এখনও পুরোপুরি ঠিক করে উঠতে পারেনি।
পশ্চিমা দেশগুলো মূলত দুইটা বড় দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল 'শান্তি শিবির' বা শান্তির পক্ষের দল, যারা এই যুদ্ধ বন্ধ এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনা শুরু করতে চায়।
অন্য দলের নাম, 'ন্যায়বিচারের দল', যারা মনে করে- রাশিয়াকে তার আগ্রাসনের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
প্রথমেই দুদলের মধ্যে যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে ভূখন্ড নিয়ে: রাশিয়া এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের যে সমস্ত ভূমি দখল করেছে তা রাশিয়ার দখলেই থাকুক; ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যে সীমানা থেকে আগ্রাসন শুরু করেছিল- সে সেই আগের সীমান্তেই ফিরে যাবে, নাকি ২০১৪ সালে দখল করা অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করতে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক সীমানার আরও দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ?- ইত্যাদি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এগোতে থাকে!
বিতর্ক শুধু এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, আরও অনেক বিষয় যুক্ত হতে থাকে। যেমন- যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার খরচ, ঝুঁকি, ফলাফল অথবা ইউরোপীয় ব্যবস্থায় রাশিয়ার অবস্থান কী হবে ইত্যাদি।
তবে ইদানিং মনে হচ্ছে, শান্তির পক্ষের দলটি ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছে। এই যেমন, জার্মানি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে; ইতালি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য তাদের নিজস্ব একটি পরিকল্পনার কথা তুলে ধরছে; ফ্রান্স রাশিয়ার জন্য "অপমান" ছাড়াই ভবিষ্যতে কীভাবে শান্তি চুক্তি করা যায়- তা নিয়ে কথা বলছে।
তবে এই দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে প্রধানত ব্রিটেন সমর্থিত পোল্যান্ড এবং বাল্টিক দেশগুলো।
তাহলে এই অবস্থায় আমেরিকার ভূমিক কী- এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে বারবার আসছে।
ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক যে দেশ, সেই দেশই ইউক্রেনকে শুধুমাত্র অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করা ছাড়া এখন পর্যন্ত তার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ও অবস্থান নির্ধারণ করতে পারেনি। এমনকি রাশিয়ার সাথে জোড়ালোভাবে দর কষাকষির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের জন্য কোনো অবস্থানও তৈরি করে দিতে পারেনি।
আমেরিকা এখন পর্যন্ত যুদ্ধে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার খরচাপাতি করেছে এবং মার্কিন কংগ্রেসে অতিরিক্ত আরও ৪০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়ার কথাও হয়েছে। এছাড়াও আমেরিকা আরও ৪০টির বেশি দেশ থেকে সামরিক অনুদান সংগ্রহ করেছে।
তবে এই সামরিক সাহায়তারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমেরিকা অস্ত্র-কামান সরবরাহ করলেও, ইউক্রেন তাদের কাছে যে দূরপাল্লার রকেট সিস্টেম চেয়েছিল, তা এখনও পোঁছায়নি। যদিও আমেরিকা সম্প্রতি ইউক্রেনকে এম-১৪২ হাই-মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম তথা হিমার্স দেবার ঘোষণা দিয়েছে!
সম্প্রতি আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড জেমস অস্টিনের মন্তব্য ধোঁয়াশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গত মাসে কিয়েভ সফরের পর তিনি বৃটেন নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ 'ন্যায়বিচারের পক্ষে'র দেশগুলির প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে বলেন, পশ্চিমাদের উচিত ইউক্রেনের জন্য "জয়" ছিনিয়ে আনা আর রাশিয়াকে আস্তে আস্তে "দুর্বল" করতে সহায়তা করা।
ঠিক আবার তিন সপ্তাহ পরে তিনি তার রাশিয়ান প্রতিপক্ষ, সের্গেই শোইগুর সাথে একটি ফোনালাপের পরে "অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি" কার্যকরের আহ্বান জানান। যদিও পেন্টাগন বারবার জোর দিয়ে বলেছে, তাদের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, হবেও না!
'ন্যায়বিচারের পক্ষ' যে দল- তাদের জন্য সম্প্রতি আরেকটা ধাক্কা আসে- যখন গত মে মাসে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট এ একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে বলা হয়, রাশিয়ার পরাজিত করার পরিকল্পনা 'অবাস্তব' ও 'বিপজ্জনক'।
এর পরেই ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার- 'যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেনের উচিৎ রাশিয়ার কাছে নিজেদের ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া'। এই যুদ্ধের 'বিপর্যয়' এবং 'উত্তেজনা' সহজে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না; তাই এগুলো এড়াতে দুই মাসের মধ্যেই উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসারও পরামর্শ দেন তিনি।
সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সাবেক এই মার্কিন মন্ত্রী ইউক্রেনে রাশিয়ার জন্য বিব্রতকর পরাজয় না চাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে তিনি আরও বলেন, এতে ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার অবনতি ঘটতে পারে।
তিনি এও মনে করেন, ইউরোপের ক্ষমতার ভারসাম্যে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং আছে; তাই রাশিয়াকে চীনের সাথে 'স্থায়ী জোট' গঠনের দিকে ঠেলে দেওয়াটা ঠিক হবে না।
আপাতদৃষ্টিতে এটাই মনে হয় যে, এই ধরনের পরস্পরবিরোধী বিবৃতি ও বক্তব্য পশ্চিমা মিত্রদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাচ্ছে। তাই ইউক্রেনীয়দের ভবিষ্যৎ কি হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসলেই এসে গেছে। তবুও একটি কথা থেকেই যায়। আর তা হলো, তারা কী সিদ্ধান্ত নেবে- তার অনেকটাই নির্ভর করে তার পশ্চিমা মিত্ররা তার জন্য কী রসদ সরবরাহ করবে- তার ওপরে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট দাভোসে এক বৈঠকে বলেন, 'ইউরোপ তথা সারা বিশ্বকে আজ এক হওয়া উচিত। আমরা আপনাদের মতো ততোটাই শক্তিশালী, যতটা আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী'। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, 'ইউক্রেন তার সমস্ত অঞ্চল ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে'।
কিন্তু তার কিছু কথাবার্তা শুনে মনে হয় যে, তিনি রাশিয়ার সাথে আপস মীমাংসার জন্য ছাড় দিতে প্রস্তুত আছেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার সাথে আলোচনা শুরু হতে পারে যদি রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের দেশের দখলকৃত ভূখন্ড ছেড়ে দেয়।
আমেরিকা, ইউরোপ এবং ইউক্রেন- এই তিন পক্ষকে পরস্পরের সাথে তাদের নিজেদের অবস্থান সঙ্গতিপূর্ণ এবং পরিস্কার করতে হবে এই ভিত্তিতে যে, তারা প্রত্যেকে কী ভাবছে, এবং সেই ভাবনাটা অন্যজন কীভাবে গ্রহণ করবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ নামক একটি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক এর বিশ্লেষক ওলগা ওলিকার বলেন, 'ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ানদের সাথে যতটা না দরকষাকষি করছে, তার চাইতেও বেশি দেনদরবার করতে হচ্ছে তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সাথেই'! কেন? ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর জন্য।
অনেক সময় অস্পষ্টতা বা ধোঁয়াশা যুদ্ধের অনিশ্চয়তাকেই তুলে ধরে। এরকম প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায় যে, ইউক্রেন কী যুদ্ধে জিতছে?
কারণ ইউক্রেন তার রাজধানী কিয়েভকে রাশিয়ানদের দখল হইয়ে যাওয়া থেকে ঠেকিয়েছে এবং তাদেরকে খারকিভ থেকে হটিয়েও দিয়েছে; নাকি তারা হেরে যাচ্ছে? কেননা, রাশিয়া মারিউপোল নিজেদের দখলে নিয়েছে এবং শীঘ্রই সেভেরোদোনেৎস্ককেও ঘিরে ফেলতে পারে।
'শান্তির পক্ষের' দল এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে- যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ইউক্রেন এবং বাকি বিশ্বের জন্য মানবিক ও অর্থনৈতিক মূল্য তত বেশি হবে।
অন্যদিকে 'ন্যায়বিচারের পক্ষের' দল পালটা যুক্তি দিয়ে বলছে যে, রাশিয়ার উপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা সবে দেশটিকে ঘায়েল করতে শুরু করেছে; আরো যত সময় গড়াবে এবং আরো যত বেশি আধুনিক অস্ত্র ইউক্রেনের হাতে এসে পৌঁছাবে, ততই ইউক্রেনীয়রা জয়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
এই সবের পিছনেও রয়েছে দুটি পরস্পরবিরোধী উদ্বেগ। এক, রাশিয়ার বাহিনী এখনও শক্তিশালী এবং তারা আগ্রাসী ও বিধ্বংসী যুদ্ধে জয়ী হবে। দুই, রাশিয়ানরা আপাতদৃষ্টিতে পরাক্রমশালী মনে হলেও আদতে তারা ভঙ্গুর।
পরাজয় এড়াতে রাশিয়া হয়তো ন্যাটোকে আক্রমণ করে বসতে পারে বা রাসায়নিক বা পারমাণবিক অস্ত্রেরও আশ্রয় নিতে পারে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখো বলেন, 'শেষ পর্যন্ত ইউরোপকে রাশিয়ার সাথে মিলেমিশে বসবাসের উপায় খুঁজে বের করতে হবে'।
মাঁখোর জবাবে এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী কাজা ক্যালাস বলেন , 'পুতিনকে উস্কানি দেওয়ার চেয়ে তার কাছে নতি-স্বীকার করা অনেক বেশি বিপজ্জনক'।
আমেরিকান ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ভেতরে ভেতরে ইউক্রেনকে সমঝোতার পথে তার অবস্থান দৃঢ় করতে সাহায্য করে যাচ্ছে। তারা যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে তা হলো, পশ্চিমাদের কাছ থেকে ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য নিশ্চয়তা আদায় করা; তাকে সরাসরি রক্ষা করার জন্য পশ্চিমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা; রাশিয়ার উপর থেকে যে যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনে পুর্নবহাল করার ক্ষমতা দেয়া; এবং ইউক্রেন আবারও আক্রমণের শিকার হলে, দ্রুত তাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা।
এই মুহূর্তে, ইউক্রেনের আশাবাদী হবার যথেষ্ট যুক্তি আছে। কারণ তারা রাশিয়ার 'সহজ' জয়ের সামনে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সম্মুখ সমরে নতুন নতুন পশ্চিমা অস্ত্রের উপস্থিতি তাদের সাফল্যও এনে দিচ্ছে। যেমন সেভারোদনেৎস্ক নগরীতে প্রতিরোধের মুখে পিছু হটেছে রাশিয়ানরা। ইউক্রেন তার হারানো ২০ শতাংশ এলাকা পুনরুদ্ধার করার দাবি করেছে।
কিন্তু জেলেনস্কির সদর দফতর থেকে কথা বলতে গিয়ে জেলেনস্কির প্রধান আলোচক মিখাইলো পোডোলিয়াক বলেন- তিনি কিছু ইউরোপীয় দেশের "ক্লান্তি ভাব" বা নিস্ক্রিয়তা দেখে উদ্বিগ্ন।
তিনি আরও বলেন, 'তারা(পশ্চিমারা) কোনকিছু সরাসরি না বললেও আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, আমাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে তাদের এটা জানা উচিৎ, যেকোনো যুদ্ধবিরতি মানেই একটা চাপা সংঘাত'। তিনি ওয়াশিংটনের নিষ্ক্রিয়তারও সমালোচনা করে বলেন, 'ইউক্রেনে প্রয়োজনীয় পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র আসছে না'।
যুদ্ধ কখন শেষ হবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করবে রাশিয়ার ওপর। যুদ্ধবিরতির জন্য তাড়াহুড়োও নেই তাদের। পূর্বের সমস্ত ডনবাস এলাকা জয় করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই মনে হয় রাশিয়ানদের এবং পশ্চিমে আরও এলাকা দখলে নেবার কথাও বলছে তারা।
কিয়েভের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভোলোদিমির ফেসেনকো বলেছেন, 'পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যে উভয় পক্ষই এখনও বিশ্বাস করে যে তারাই জিতবে। যদি সত্যিই এমন একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়, এবং মস্কো ও কিয়েভ যদি এটিকে স্বীকার করে নেয়- তাহলে কি আদৌ কোনো সমঝোতার পথ খোলা থাকবে?'
- সোহেল রানা- লেখক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী
- তথ্যসূত্র: দি ইকোনোমিস্ট, দি ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইম ম্যাগাজিন