রুশ এলএনজির ওপর থেকে এখনও নির্ভরতা কাটেনি ইউরোপের
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধের সময়সীমা, ৫ ডিসেম্বর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রুশ জ্বালানির ওপর থেকে ইউরোপের নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা বেড়েই চলেছে। তবে, এখনও পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার শূন্যতা কাটিয়ে ওঠার বিকল্প অবলম্বন খুঁজে পায়নি।
রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা প্রথমে যটটুকু ভাবিয়েছিল ইউরোপীয়দের, আদোতে সে সংকট আরও কয়েকগুণ বেশি বলেই মনে হচ্ছে এখন। এদিকে, তেল সংকট এবং দাম বেড়ে যাওয়ার ভয়ে মস্কোর ওপর আর নিষেধাজ্ঞা দিতে চাইছে না ইউরোপ। যদিও বছরের শুরুতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে রুশ কয়লা এবং তেলের আমদানি ইউরোপে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, তবে অন্যদিকে আবার রাশিয়ার এলএনজির (তরল গ্যাস) ওপর অনেক বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপ অঞ্চল।
রিস্ট্যাড এনার্জির মতে, ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে রাশিয়ার তরল গ্যাসের রপ্তানি প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাশিয়ার মোট এলএনজি রপ্তানির পরিমাণ ১.২ মিলিয়ন টন, যার আর্থিক মূল্য ১ থেকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।
এদিকে, শীত সামনে জ্বালানি মজুদে মরিয়া হয়ে উঠেছে ইউরোপ। অয়েল প্রাইস ডট কমে প্রকাশিত ফেলিসিটি ব্র্যাডস্টকের লেখা এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্টোরেজ লেভেলের ধারণক্ষমতা প্রায় ৯৫ ভাগ। ইউরোপীয় বন্দগুলোতে এলএনজি বহনকারী অনেক জাহাজ এখন আটকে আছে; কারণ এলএনজি কার্গোগুলো আনলোড করার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রাশিয়া বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম এলএনজি উৎপাদক। স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের এলএনজির চাহিদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাই নর্ড স্ট্রিম ১ থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপীয় দেশগুলোর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে রাশিয়ার এলএনজির ওপর।
অয়েল প্রাইজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটি ইউরোপের মোট চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ এলএনজি সরবরাহ করে। সুতরাং, খুব সহজে কিংবা স্বল্প সময়ের মধ্যেই রাশিয়ার শূন্যতা পূরণের সুযোগ হবে না ইউরোপীয়দের। জ্বালানি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী বছর নাগাদও রুশ এলএনজি আমদানির এই পরিমাণ কমার তেমন সম্ভাবনা নেই।
এদিকে, ইউক্রেনে আক্রমণের জেরে রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই নিষেধাজ্ঞাগুলো আবার ইইউ অনুসরণ করছে। বিশ্লেষকদের মত, এমন পদক্ষেপ অনুসরণের পর রাশিয়ান গ্যাসের ওপর ইউরোপীয়দের নির্ভরতা ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে। কারণ দুঃজনক হলেও সত্য, রাশিয়া থেকে জ্বালানি রপ্তানি কমে গেলে বিপদে পড়বে ইউরোপ।
এমন অবস্থায় রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে ইউরোপ বিশ্বের অন্যান্য গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলোর দিকে নজর রাখছে।
জ্বালানি সংকট কাটিয়ে উঠতে চলতি বছরের মার্চে 'রিপাওয়ার ইইউ' পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে ইইউ। এই পরিকল্পনার অন্যতম বড় একটি অংশ হলো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস গড়ে তোলা। এছাড়া, পরিকল্পনার আওতায় ইইউ রাশিয়ার পর দ্বিতীয় বৃহত্তম আঞ্চলিক গ্যাস উৎপাদনকারী নরওয়েকে ইউরোপের সম্ভাব্য সরবরাহকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০২৭ সালের মধ্যে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর থেকে ইইউ'র নির্ভরতা সরিয়ে আনতে ক্রমাগতভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছে নরওয়ে।
ফেলিসিটি ব্র্যাডস্টকের লেখা অনুসারে, কিছু দেশ ইতোমধ্যে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য উত্স থেকে গ্যাসের ব্যবহার বাড়িয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশটি এখন রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল নয়; কারণ যুক্তরাজ্যের শক্তিসংস্থা সেন্ট্রিকা পরবর্তী তিন শীতে অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহের জন্য নরওয়ের ইকুইনোরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একইভাবে সাইপ্রাস, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ রাশিয়ার বিকল্প উৎস খুঁজছে।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপের রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে বড় ভূমিকা রাখছে। তারপরেও চলতি বছরজুড়ে এলএনজির আকাশছোঁয়া দামে জ্বালানি সংকটের দুশ্চিন্তা কমেনি ইউরোপীয়দের।
ইউরোপের ওপর থেকে জ্বালানি সংকটের অশনি সংকেট খুব দ্রুতই কাটবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এখনও ইউরোপের অন্যতম বড় ও ধনী দেশ জার্মানির চাহিদার ৪৬ শতাংশ এবং ফ্রান্সের ২৪ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ হয় রাশিয়া থেকে।
যতই চেষ্টা হোক না কেনো, রাশিয়ার এলএনজির ওপর থেকে ইউরোপের নির্ভরতা কমানো এই মুহূর্তে সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফেলিসিটি ব্র্যাডস্টকের লেখায়ও এমনটিই বলা হয়েছে। এর প্রমাণও মিলেছে খুব সহজেই। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাতে রাশিয়ার অর্থ খরচে ব্যাঘাত ঘটে সেজন্যই মূলত পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে রুশ গ্যাসের ওপর। আর সেই গ্যাসের শূন্যতা পূরণে আবার রাশিয়া থেকেই তারা আমদানি করছে এলএনজি। ঘুরেফিরে রাশিয়ার কাছেই ইউরোপীদের অর্থ যাচ্ছে। মাঝখান দিয়ে নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব বাজারে তৈরি হয়েছে সংকট, দাম বেড়েছে জ্বালানির।
আর যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহের যে আশা তৈরি হয়েছে, তা কেবল স্বল্পমেয়াদী সমাধান এনে দিতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক গ্যাস কাঠামো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইউরোপের জ্বালানি সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান এনে দিতে পারলেও তা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ একটি ব্যাপার।
- সূত্র: অয়েল প্রাইস ডট কম