যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে আব্রামস না দিলে ইউক্রেনে লেপার্ড ট্যাংক পাঠানোর অনুমতি দেবে না জার্মানি
যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজদের তৈরি আব্রামস ট্যাংক ইউক্রেনকে না দেয়, তাহলে মিত্র দেশগুলোর হাতে থাকা জার্মানির তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠানোর অনুমতি দেবে না বার্লিন। বুধবার (১৮ জানুয়ারি) একথা জানিয়েছেন জার্মান সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
লেপার্ড-২ বা লিওপার্ড-২'কে বিশ্বের অন্যতম সর্বাধুনিক মেইন ব্যাটেল ট্যাংক (এমবিটি) হিসেবে গণ্য করা হয়। যুক্তরাজ্যের লন্ডন-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্যমতে, মিত্রদের কাছে জার্মানির তৈরি এ ধরনের প্রায় দুই হাজার লিও-২ এমবিটি রয়েছে।
এসব মিত্রদের অধিকাংশই ইউরোপীয় দেশ। এদের মধ্যে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক সাম্প্রতিক সময়ে জানিয়েছে, জার্মানির সবুজ সংকেত পেলে তারা ইউক্রেনকে এই ট্যাংক দেবে। এর কারণ, জার্মানির রয়েছে কঠোর অস্ত্র রপ্তানি আইন। এর আওতায়, কোনো সংঘাত অঞ্চলে জার্মান সমরাস্ত্র পাঠানোর আগে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। তবে যেসব দেশ ট্যাংক পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে – তারা কেউই আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করেনি বার্লিনকে।
এর পাশাপাশি ব্রিটেনও ইউক্রেনে তাদের চ্যালেঞ্জার-২ এমবিটি পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে, এই ট্যাংককেও লিও-২ এর সমকক্ষ বলে গণ্য করা হয়।
জার্মানি নিজেদের অস্ত্র সংঘাত অঞ্চলে রপ্তানির বিষয়ে বরাবরই সংবেদনশীল। এবিষয়ে এক জ্যেষ্ঠ জার্মান কর্মকর্তা বলেছেন, 'আমাদের সরাসরি রপ্তানি করা ট্যাংকের সাথে, তৃতীয় কোনো দেশের রপ্তানি করা (জার্মানিতে প্রস্তুতকৃত) ট্যাংকের পার্থক্য নির্ধারণ করা কঠিন'। অর্থাৎ, রাশিয়া এগুলো জার্মানির পাঠানো অস্ত্র হিসেবেই গণ্য করবে।
ইউক্রেনকে নিজদের আব্রামস ট্যাংক দিতে যুক্তরাষ্ট্র এখনও আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পেন্টাগনের প্রতিরক্ষা নীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি কলিন কাহল। পেন্টাগনের তিন নম্বর এই কর্তাব্যক্তি বুধবার এমনটাই জানান সাংবাদিকদের।
জার্মানি প্রথমে আমেরিকার প্রতি অ্যাব্রামস ট্যাংক পাঠানোর যে আহ্বান জানিয়েছে, সেবিষয়ে সরাসরি মন্তব্য না করে তিনি বলেন, 'আব্রামস খুব জটিল প্রযুক্তির দামি এক ট্যাংক। এটি পরিচালনায় প্রশিক্ষিত হওয়াটা বেশ কঠিন। এই ট্যাংক জেট ইঞ্চিন চালিত… ফলে রক্ষণাবেক্ষণও সহজ না'।
তিনি আরো বলেন যে, পেন্টাগন ইউক্রেনকে এমন সরঞ্জাম দিতে চায় না 'যা তারা মেরামত করে সচল রাখতে বা দীর্ঘমেয়াদে এটি সার্ভিসে রাখতে পারবে না'।
এই নীতির ফলে 'শুধু সংবাদের শিরোনাম হবে বা প্রতীকীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হবে এমন সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে না। আর এ নীতি ইউক্রেনকেই সাহায্য করছে'- যোগ করেন তিনি।
তবে জার্মানিকে তাদের তৈরি ট্যাংক পাঠানোর অনুমতি দিতে রাজি করানোর বিষয়ে আশাবাদী যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য বার্লিনে গেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। তিনি জার্মানির সদ্য দায়িত্বগ্রহণ করা প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিসতোরিউস এর সাথে বৈঠক করবেন।
অচিরেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে বড় ধরনের আক্রমণ অভিযান শুরু হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই হুমকি মোকাবিলায় জার্মানির তৈরি ট্যাংক ইউক্রেনকে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
জ্যেষ্ঠ একজন মার্কিন কর্মকর্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, 'এজন্যই ইউক্রেনের আধুনিক, সাঁজোয়া সক্ষমতা তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন তারা (পেন্টাগনের কর্মকর্তারা)। ট্যাংকের দিকেও এজন্যই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জার্মানির সহযোগিতা এই সক্ষমতা তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমানে লেপার্ড-২ ট্যাংক মিত্রদের হাতে বিপুল পরিমাণে রয়েছে, যা সহজে সরবরাহ করা যাবে। এর সক্ষমতা খুবই কার্যকর হতে পারে যুদ্ধের ময়দানে'।
তিনি বলেন, 'চলতি সপ্তাহের শেষ নাগাদ এবিষয়ে অগ্রগতি হবে বলে আমরা খুবই আশাবাদী'। তবে ওই কর্মকর্তা জার্মানির সাম্প্রতিক অবস্থান সম্পর্কে অবহিত কিনা- সে বিষয়ে জানা যায়নি।
ইউক্রেনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় পশ্চিমা দেশে প্রস্তুতকৃত আধুনিক ট্যাংক সরবরাহ – কিয়েভের জন্য পশ্চিমা সমর্থনকে অনেকখানি বৃদ্ধি করবে। এর আগে এমন সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে রাজি ছিল না যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বার্লিনের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ, এমন সহায়তা জার্মানিকে রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে।
বুধবার জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, ট্যাংকসহ ইউক্রেনকে অন্যান্য সহায়তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জার্মানি তার মিত্র ও অংশীদারদের সাথে 'কৌশলগতভাবে যুক্ত'।
একথার মাধ্যমে ওয়াশিংটনের অবস্থানের সাথে জার্মানির অভিন্ন অবস্থানকে তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর ইউক্রেনে আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর চাপ সৃষ্টি করলেন।
কূটনৈতিক এই টানাপোড়েনের মধ্যে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ (জয়-পরাজয় নির্ধারণের) এক কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রয়েছে, এই অবস্থায় ন্যাটো মিত্রদের উচিত কিয়েভকে আরো বেশি বেশি ভারী অস্ত্র, বিশেষত ট্যাংক সরবরাহ করা।
সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে অংশগ্রহণকালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ন্যাটো দেশগুলোর পক্ষ থেকে 'আরো আধুনিক ও ভারী সমরাস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা' প্রত্যাশা করছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা অতিরিক্ত সাঁজোয়া যান সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু জিততে হলে কিয়েভের এ ধরনের সহায়তা আরো বড় পরিসরে দরকার বলেও জানান তিনি।
স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, 'এর অর্থ এরমধ্যেই যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ সাঁজোয়া যান দিতে হবে। দিতে হবে ব্যাটেল ট্যাংক, যেমনটা সম্প্রতি ফ্রান্স ও ব্রিটেন ঘোষণা দিয়েছে। অত্যাধুনিক আকাশ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আরো বেশি সংখ্যক দিতে হবে'।
ইউক্রেনের প্রধান সমর্থক ৫০টি দেশের একটি জোট– ইউক্রেন ডিফেন্স কন্ট্যাক্ট গ্রুপ আগামী শুক্রবার জার্মানিতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের রামস্টেইন বিমানঘাঁটিতে বৈঠক করবে। এই বৈঠকে কিয়েভের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
বৈঠকের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে ইউক্রেনে জার্মানির তৈরি ট্যাংক পাঠানোর বিষয়টিও থাকবে বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানিয়েছেন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর কয়েকজন কূটনীতিক।
তবে তারা জানান, শলৎজ সরকার এখনও জার্মান প্রস্তুতকৃত ট্যাংক পাঠানোর অনুরোধ পায়নি। তবে পাওয়া মাত্রই তাৎক্ষণিক একটা সিদ্ধান্ত নেবে বলে তারা মনে করছেন। এই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কয়েক দিন থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানান তারা।