এআইয়ের ওপর প্রভুত্ব করা শিখতে হবে এআই আমাদেরকে করার আগেই: ইউভাল হারারি
নভেম্বরের শেষে ওপেনএআই চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত করার পরেই মাইক্রোসফট আর গুগলসহ বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে নতুন এবং কর্মক্ষম এআই প্রযুক্তি বাজারে আনার জন্য। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা মানব সভ্যতাকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে?
স্যাপিয়েন্স, হোমো ডিউস এবং আনস্টপেবল আসের লেখক ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারির মতে, "যখন 'মানবসভ্যতা তাদের সবচেয়ে গর্বের অস্ত্র 'বুদ্ধিমত্তা' ব্যবহার' শুরু করে তখন বাজার দখলের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই প্রযুক্তির উন্নয়নের গতি ঠিক করে দেওয়া উচিৎ নয়। বরং, এটির নিজস্ব গতিতে চলা উচিৎ, যাতে আমরা এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারি।"
সেন্টার ফর হিউমেন টেকনোলজির দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা ট্রিস্টান হ্যারিস এবং আজা রাসকিনের সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে গত শুক্রবার তার মতামত প্রকাশ করেন ইউভাল নোয়াহ হারারি। তার মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যদি 'দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ব্যবহার' করা হয়, তবে সেটি আমাদের 'সভ্যতার মূলভিত্তির জন্য হুমকি'।
মার্চের ১৪ তারিখ মাইক্রোসফটের সহায়তায় ওপেনএআই চ্যাটজিপিটির পরবর্তী সংস্করণ জিপিটি-৪ উন্মুক্ত করে। চ্যাটজিপিটি যেখানে ইতিমধ্যেই সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের আশ্চর্য করে দিয়েছে, এবং হয়ে উঠেছে ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুত ভোক্তা টেনে নেওয়া প্রযুক্তি, সেখানে জিপিটি-৪-এর সক্ষমতা এর কয়েক গুণ। চালু হওয়ার কয়েকদিনেরই মধ্যে ইন্টারনেট জগতে শুরু হয়েছে 'হাসেলজিপিটি চ্যালেঞ্জ', যেখানে ব্যবহারকারীরা প্রদর্শন করছেন কীভাবে তারা জিপিটি-৪ ব্যবহার করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুলে ফেলছেন এক নতুন কোম্পানি, যে কাজটি আগে করতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সময় লেগে যেত।
হারারি এবং তার সহ-লেখকরা জানিয়েছেন "জিপিটি-৪ এবং এর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টুলগুলো সক্ষমতা চিন্তা করতে গিয়েই আমাদের মানব মস্তিষ্ক দিশা হারিয়ে ফেলছে। আর এগুলো যত দ্রুত আরও উন্নত ও সক্ষম হয়ে উঠছে, তাতে সেগুলো চিন্তা করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।"
মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এ সপ্তাহে তার ব্লগে 'এআইকে মাইক্রোপ্রসেসর, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের মতোই গুরুত্বপূর্ণ' বলে দাবি করেছেন। তার মতে, "পুরো ব্যবস্থাটাই এআইকে কেন্দ্র করে ঘুরবে। কতটা ভালোভাবে ব্যবসাগুলো এআইকে ব্যবহার ক্রতে পারবে তার ওপর নির্ভর করবে তারা কত উন্নতি করতে পারবে।"
কেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপজ্জনক?
হারারি স্বীকার করেছেন যে এআইয়ের মানবসভ্যতাকে সাহায্য করার সক্ষমতা রয়েছে। ক্যান্সার প্রতিরোধ করা, জীবন বাঁচানো ঔষধ তৈরি কিংবা পরিবেশ রক্ষা ও জ্বালানি সংকটের সমাধান করতেও এআই আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে। তবে তার মতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপজ্জনক, কারণ এখন এর ভাষার ওপর দখল রয়েছে। যার অর্থ এখন সভ্যতার মূল অপারেটিং সিস্টেম এর দখলে, যার ফলে এটি এখন সভ্যতাকে 'হ্যাক কিংবা ম্যানিপুলেট' করতে সক্ষম।
হারারি প্রশ্ন করেছেন, "কেমন হবে সেই পৃথিবী যেখানকার গল্প, সাহিত্য, ছবি, আইন আর নীতিমালার বেশিভাগই হবে অ-মানবের তৈরি? মানবসভ্যতা কীভাবে এর সাথে খাপ খাওয়াবে?" তার মতে, "কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পুরো মানব সংস্কৃতিকেই 'খেয়ে' ফেলবে। আমরা কয়েক হাজার বছর ধরে যা উৎপাদন করেছি, তার সবকিছু 'হজম' করে একের পর এক নতুন সাংস্কৃতিক বিষয় উৎপাদন শুরু করবে এআই।"
চিত্রকরেরা ইতিমধ্যেই এই এআই টুলগুলোর বিরুদ্ধে তাদের তৈরি ছবি 'খেয়ে ফেলার' অভিযোগ করেছেন এবং স্ট্যাবিলিটি এআইয়ের মতো পণ্যের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। তাদের মতে ব্যবহারকারীদের টেক্সট প্রম্পট ব্যবহার করে যে জটিল চিত্রকর্ম এই এআইগুলো বের করে, সে সময় এই এআইগুলো ইন্টারনেটে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন ছবির সাহায্য নেয়। এই ইন্টারনেটে থাকা ছবিগুলোর অনেকগুলোর শিল্পীই তাদের কাজ ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি, এমনকি তারা কোনো অর্থও পায় না।
"আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, আমাদের দৈনন্দিন জীবন একসময় পুরো এআইনির্ভর হয়ে উঠবে। আমরা যদি সেই চরম বিশৃঙ্খলার জন্য অপেক্ষা করি, তাহলে সেই অবস্থা থেকে ফিরে আসার জন্য অনেক দেরি হয়ে যাবে।"
ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান জানিয়েছেন এআইয়ের সাথে মানিয়ে নিতে সমাজের আরও সময় লেগে যাবে। গত মাসেই টুইট করে তিনি জানান, "আমাদের এআইয়ের নীতিমালা কঠোর করা হবে। কীভাবে মানুষ এগুলো ব্যবহার করতে চাচ্ছে, কীভাবে এআইয়ের সাথে সমাজ মানিয়ে নিচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এবং এগুলো বুঝতে আমাদের বেশ সময় লাগবে।"
তিনি আরও সতর্ক করে দিয়ে বলেন, চ্যাটজিপিটি বা জিপিটি-৪-এর বিপজ্জনক ব্যবহার প্রতিরোধ করার জন্য তারা 'কীভাবে ১ ডলার দিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ খুন করা যাবে'-র মতো প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করলেও বাকি ডেভেলপাররা এ ধরনের নীতি অনুসরণ না-ও করতে পারেন।
হারারি জিপিটি-৪-এর মতো প্রযুক্তিগুলোকে অ্যাখ্যা দিয়েছেন এআইয়ের দ্বিতীয় স্তর হিসেবে, যেখানে আমরা প্রথম স্তরেই হেরে বসে আছি। তার মতে এআইয়ের প্রথম স্তর হলো সামাজিক মাধ্যমের ফিডে ইউজার-জেনারেটেড কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করতে সক্ষম এআইগুলো, যারা ব্যবহারকারীদের মনোযোগ আরও ধরে রাখার কাজে সাহায্য করে এবং একইসাথে সামাজিক দূরত্ব বাড়ায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, মার্কিন নাগরিকরা আর এখন কাকে ভোট দিয়ে জেতাবে সে ব্যাপারে একমত হতে পারছে না, সেই সিদ্ধান্ত এআই দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
হারারি বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, "এখনই সমই এই চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করতে কাজ করা, যার প্রথম ধাপ হলো উনবিংশ শতাব্দীর ছাঁচে তৈরি সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে এআই-পরবর্তী যুগের জন্য ঢেলে সাজানো। আমাদেরকে এআইয়ের ওপর প্রভুত্ব করা শিখতে হবে তারা আমাদের ওপর প্রভুত্ব করার আগেই।"
ঠিক কী উপায়ে নীতিমালা বা আইন তৈরি করা হবে, তা নিয়ে অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলেননি হারারি। তবে ইতিহাসের বাঁকবদলের এই মোড়ে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, "আমাদের হাতে এখনো সময় আছে আমরা এআই দিয়ে কী করবো সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের। যখন ঐশ্বরিক শক্তির সাথে দায়িত্ব আর নিয়ন্ত্রণ যুক্ত হবে, কেবল তখনই আমরা এআইয়ের প্রকৃত সুবিধা পাবো।"
সূত্র: ফরচুনডটকম