গাজা নিয়ে ইসরায়েলের সামরিক পরিকল্পনায় আস্থা রাখতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র
গাজায় অর্জনযোগ্য সামরিক লক্ষ্য ঠিক করতে পারেনি ইসরায়েল, এমন ধারণাই করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। এনিয়ে তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বাইডেন প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, স্থল অভিযানের ফলপ্রসূ একটি পরিকল্পনা এখনও প্রস্তুত করতে পারেনি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)।
সম্প্রতি মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড জে. অস্টিন তার ইসরায়েলি সমকক্ষ ইয়োভ গ্যালান্টের সাথে ফোনালাপে এ উদ্বেগ তুলে ধরেন।
গাজায় রয়েছে হামাসের নির্মিত জটিল ও বিস্তৃত সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক। এই অবস্থায়, ইসরায়েলি সেনারা কোন কৌশলে সেখানে অভিযান চালাবে তা সতর্কভাবে মূল্যায়নের ওপর জোর দেন অস্টিন।
মার্কিন কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, কী করা উচিত সেবিষয়ে তারা ইসরায়েলকে কিছু বলেননি এবং তাদের স্থল অভিযানকে সমর্থনও করছেন। তবে নগর-যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইসরায়েলি সমর পরিকল্পনায় সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেমস গ্লিনসহ আরও কিছু দক্ষ অফিসারকে তেল আবিবে পাঠিয়েছে পেন্টাগন। এদের মধ্যে জেমস গ্লিন মার্কিন নৌসেনার একজন তিন-তারকা জেনারেল।
সোমবার পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা বলেন, জেনারেল গ্লিনকে পাঠানোর মানে এটা নয় যে, পেন্টাগন ইসরায়েলের সিদ্ধান্তগুলো নেবে বা কোনকিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দেবে। গাজায় অভিযান শুরু হলে, গ্লিন সেখানে উপস্থিত থাকবেন না।
এবিষয়ে ওয়াশিংটনে অবস্থান করা ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চায় দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। কিন্তু, তারা কোন মন্তব্য করতে চাননি।
তবে মার্কিন সরকার ইসরায়েলিদের স্থল অভিযানে দেরি করার পরামর্শ দিচ্ছে এমন সংবাদকে নাকচ করেছেন ইসরায়েলি দূতাবাসের এক কূটনীতিক। তিনি বলেন, 'স্থল অভিযানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে কোন ধরনের চাপ দিচ্ছে না।'
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টের সাথে ফোনালাপের সময় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ইরাকের মসুল শহর থেকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের নির্মুলে যুক্তরাষ্ট্রকে যে কঠিন লড়াই করতে হয়েছিল, তার বর্ণনা দেন অস্টিন।
সে সময় অস্টিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় কম্যান্ডের প্রধান ছিলেন। মসুল আইএসআইএস এর দখলমুক্ত করতে তখন ইরাকি ও কুর্দি সেনাদের সহায়তা করেছিল মার্কিন সেনারা।
গত রোববার এবিসি নিউজের 'দিস উইক' অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে অস্টিন বলেন, 'নগর-যুদ্ধ প্রচণ্ড কঠিন, এটাই সবার আগে জেনে রাখা দরকার। আমি মনে করি, (সামরিক সংশ্লিষ্ট) সবাই তা ভালো করেই জানেন।'
অস্টিন জানান, যুদ্ধের আইন অনুযায়ী অভিযান চালাতে তিনি গ্যালান্টকে 'উৎসাহ' দেন।
কারণ মার্কিন কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে।
পেন্টাগনের কর্মকর্তারা জানান, সোমবার পুনরায় গ্যালান্টের সাথে ফোনালাপ করেছেন অস্টিন। আলোচনার সময় তিনি 'বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা'র বিষয়ে জোর দেন।
পেন্টাগনের একজন প্রেসসচিব এক ইমেইলে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানান, উভয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মধ্যে ইসরায়েলে আমেরিকার সামরিক সহায়তা পাঠানো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
তবে মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্বেগ তাতেও দূর হয়নি। তারা বলছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন, সেটি অর্জনের স্পষ্ট সামরিক পন্থা এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কাছে নেই।
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলার পর থেকেই মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা তেল আবিবের সাথে আলোচনা করছেন। কিন্তু, এপর্যন্ত অর্জনযোগ্য কোন কর্মপরিকল্পনা তারা দেখতে পাননি বলে জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে ইসরায়েল সফরকালে এ উদ্বেগের কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলকে 'লক্ষ্যের বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানতে হবে এবং কীভাবে সেগুলো অর্জন করা যাবে– সে বিষয়ে একটি সৎ পর্যালোচনা করতে হবে।'
মসুলে মার্কিন যুদ্ধবিমান ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের অবস্থানে সার্জিক্যাল হামলা করেছে, আর ইরাকি ও কুর্দি সেনারা ভূমিতে অভিযান চালিয়েছে। ইসরায়েল তার বিমান ও বিশেষ বাহিনীর সাহায্যে এই কৌশল গ্রহণ করতে পারে, অথবা সরাসরি ট্যাংক ও পদাতিক সেনা নিয়ে ঢুকে পড়তে পারে গাজায়, যেমনটা ২০০৪ সালে ফাল্লুজা শহরে করেছিল মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনারা।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, এ দুটি উপায়ের যেকোন একটি গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ইসরায়েলকে।
কিংতু উভয় কৌশলেই হতে পারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেন, সৈন্য ও সাধারণ মানুষ উভয়ের জন্যেই গাজায় সামরিক অভিযান হবে আরও রক্তক্ষয়ী।
ফাল্লুজার লড়াইয়ের এক দশকের বেশি সময় পরে রাক্কা ও মসুলে আইএসআইএস জঙ্গিদের নির্মুলে অভিযান চালানো হয়। পেন্টাগনের অনেক কর্মকর্তাই মনে করেন, এ দুটি ক্ষেত্রে নেওয়া অভিন্ন কৌশল – নগর-যুদ্ধের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো ও অনুকরণীয় মডেল হবে ইসরায়েলের।
যেমনটা রোববার বলেছেন লয়েড অস্টিন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, 'যুদ্ধাঞ্চলে কীভাবে বেসামরিক নাগরিকদের কথা বিবেচনায় রাখতে হয়, সেটা আমরা শিখেছি। কারণ, তারাও (শহুরে) যুদ্ধক্ষেত্রের অংশ, তাই যুদ্ধের আইন অনুযায়ী, তাদেরকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।'
কিন্তু, অস্টিনের এই দাবি ন্যায্য নয়। মসুল ও রাক্কায় অভিযানকালে ব্যাপক বেসামরিক প্রাণহানি হয়েছে। মার্কিন বিমান হামলায় অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক হিসাবমতে, মসুলে আইএসআইএস-বিরোধী অভিযানের সময় অন্তত ৯ থেকে ১১ হাজার বেসামরিক লোকজন নিহত হয়।
অথচ, জোট বাহিনীর আক্রমণ মসুলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মাত্র দুই বছর সময় পেয়েছিল ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা– বিষয়টি উল্লেখ করে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের ফেলো মাইকেল নাইটস বলেন, 'স্তরে স্তরে প্রতিরোধ ব্যূহ নির্মাণে ১৫ বছর সময় পেয়েছে হামাস। ফলে তারা মাটির নিচে, ওপরে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে – লড়াইয়ের স্থান, যোগাযোগের সুড়ঙ্গ ইত্যাদি গড়ে তুলেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'একইসঙ্গে মাইনক্ষেত্র, ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) এবং এক্সপ্লোসিভলি ফর্মড পেনেট্রেটর অ্যান্টি-আর্মার মাইন থাকতে পারে হামাসের কাছে। হয়তো বিভিন্ন ভবনে বিস্ফোরক বসিয়ে সেগুলো ফাঁদ হিসেবেও ব্যবহার করবে তারা।'