বায়ুদূষণের কারণে মেয়েদের সময়ের আগেই পিরিয়ড শুরু হচ্ছে: গবেষণা
বাতাসে বিদ্যমান বিষাক্ততা ও দূষণের কারণে প্রত্যাশিত সময়ের আগেই পিরিয়ড বা ঋতুচক্র শুরু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্যই খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। খবর বিবিসি'র।
গত কয়েক দশক ধরে নির্ধারিত সময়ের আগেই মেয়েদের বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করার ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের সূচনা চিহ্নিত করে এমন পরিবর্তন যেমন ঋতুস্রাবের শুরু এবং স্তনের বিকাশ প্রত্যাশিত সময়ের আগেই ঘটছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বাল্যকালের পরেই আসে কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকাল। বয়ঃসন্ধি এমন একটি সময়, যে সময়ে একটি শিশুর শরীর ধীরে ধীরে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে রূপান্তরিত হয় এবং প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে ৷
আমেরিকান মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার গড় বয়স সময়ের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে। সম্প্রতি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া মেয়েদের সাধারণত গড়ে ১২ বছর ৬ মাস বয়স থেকে ঋতুস্রাব শুরু হলেও ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে জন্মগ্রহণকারী মেয়েদের ক্ষেত্রে এই গড় বয়স ১১ বছর ১১ মাসে নেমে এসেছে।
সময়ের আগেই বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশের এই প্রবণতা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দেখা গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আট বছর বয়সের আগেই স্তনের বিকাশ বা ঋতুস্রাব হওয়া দক্ষিণ কোরিয়ান মেয়েদের অকাল বয়ঃসন্ধির লক্ষণ প্রদর্শনের সংখ্যা ১৬ গুণ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অড্রে গ্যাসকিন্স বলেন, 'আমরা এটাও দেখছি যে, অকাল বয়ঃসন্ধিকালের প্রবণতা নিম্ন আর্থ-সামাজিক এবং জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে আরও বেশি প্রকট। এই পরিবর্তনটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।'
অকাল বয়ঃসন্ধিকাল মেয়েদের মা হওয়ার সময়কাল কমিয়ে দিতে পারে, নির্ধারিত সময়ের আগেই মেনোপোজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া এমনকি আয়ুও হ্রাসেরও কারণ হতে পারে। এছাড়া স্তন এবং ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার, স্থূলত্ব, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো রোগের উচ্চ ঝুঁকিও আছে।
বিজ্ঞানীরা এখনও এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রেন্ডা এসকেনাজি বলেন, 'যদি দেহের কোষগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য ইস্ট্রোজেনের মতো যৌন হরমোনের সংস্পর্শে আসে তবে এটি টিউমারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে কারণ এই হরমোনগুলো কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।'
তিনি বলেন, 'হরমোনের সংস্পর্শে বেশি সময় থাকলে প্রজনন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।'
এসকেনাজি উল্লেখ করেছেন যে, মেয়েরা আগে বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করায় তাদের আগে যৌন সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।
এসকেনাজিরের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাত অবৈধ হয়ে উঠছে এবং গর্ভনিরোধকও সহজলভ্য না। এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করা কিশোরীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা খুবই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক।
স্থূলতা থেকে বায়ু দূষণ
বয়ঃসন্ধিকালের সূচনা শরীরের দুটি প্রধান যোগাযোগ নেটওয়ার্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল (এইচপিএ) এক্সিস এবং হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-গোনাডাল (এইচপিজি) এক্সিস হিসেবে পরিচিত। এই নেটওয়ার্কগুলো মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসকে হরমোন-সিক্রেটিং গ্রন্থিগুলোর সাথে সংযুক্ত করে।
এইচপিএ এবং এইচপিজি এক্সিস একটি নিউরোএন্ডোক্রাইন সিস্টেম। এটিতে এমন কোষ রয়েছে যা স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষের রক্তে (এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের মাধ্যমে) হরমোন নিঃসরণ করে।
গ্যাসকিন্স ব্যাখ্যা করেছেন যে ১০ থেকে ২০ বছর আগে পর্যন্ত, বিজ্ঞানীরা ভাবতেন যে শৈশবকালীন স্থূলতা বয়ঃসন্ধিকালের একমাত্র কারণ। অ্যাডিপোকাইনস নামে পরিচিত ফ্যাট কোষ দ্বারা তৈরি প্রোটিনগুলো এইচপিএ এবং এইচপিজি গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করত বলে মনে করা হতো। তবে এ ধারণা পাল্টেছে, এর পেছনে অন্যান্য কারণও জড়িত রয়েছে বলে জানান গ্যাসকিন্স।
এর পরিবর্তে, পেছনের কারণ হিসেবে গত তিন বছরে বেশ কয়েকটি গবেষণা আরও একটি আশ্চর্যজনক কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছে— তা হলো বায়ু দূষণ।
উক্ত গবেষণার বেশিরভাগই দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা করেছেন, যেখানে সিউল, বুসান এবং ইনচিয়নের মতো শহরগুলো আইকিউএয়ার সূচক অনুসারে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ দূষিত শহরের তালিকার মধ্যে রয়েছে।
সিউলের ইওয়া উইমেনস ইউনিভার্সিটি থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি পর্যালোচনাতে বিভিন্ন দূষণকারীর সংস্পর্শে আসা এবং অকাল বয়ঃসন্ধিকালে পা রাখাদের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
ধারণা করা হয় সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং ওজোনের মতো বিষাক্ত গ্যাসগুলো আগেভাগে শুরু হয়ে যাওয়া বয়ঃসন্ধিকালের মূল কারণ। যার বেশিরভাগই যানবাহনের ধোঁয়া বা উৎপাদন কারখানা হতে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
২০২২ সালে, খারাপ বায়ু মানের দেশ পোল্যান্ডের ১,২৫৭ জন নারীর ওপর একটি গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারীরা বাতাসের অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গ্যাসে উন্মুক্ত ছিলেন, তাদের ১১ বছর বয়সের আগেই ঋতুস্রাব শুরু হয়েছে।
তবে এর চেয়েও বড় চিন্তার কারণ হলো বাতাসে বিদ্যমান সূক্ষ্ম কণা পদার্থ (পিএম)। ক্ষতিকারক এই ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো নির্মাণাধীন ভবন, দাবানল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, যানবাহনের ইঞ্জিন এবং রাস্তার ধূলিকণার মতো উৎস থেকে বাতাসে নির্গত হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে, গ্যাসকিনস এবং তার সহকর্মীরা দেখতে পান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব মেয়েরা তাদের মায়ের গর্ভে এবং শৈশবকালে উভয় সময়েই পিএম ২.৫ (২.৫ মাইক্রোমিটারের চেয়ে কম ব্যাসের কণা) এবং পিএম ১০ সমৃদ্ধ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে ছিলেন, তাদের প্রত্যাশিত সময়ের আগেই, কম বয়সে ঋতুস্রাব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
গ্যাসকিন্স জানান, পিএম ২.৫ কণা খুব সহজেই মানুষের রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করতে পারে। অতিসূক্ষ্ম বলেই পিএম ২.৫ নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের দেহে প্রবেশ করে বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে যায়।
তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি প্লাসেন্টা, ভ্রূণের টিস্যু, ডিম্বাশয়ে কিছু পিএম ২.৫ কণা প্রবেশ করতে পারে, এগুলোর দেহের সব জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে।'
গবেষণায় দেখা গেছে, বাতাসে পাওয়া সূক্ষ্ম কণার রাসায়নিকগুলো হরমোন রিসেপ্টরের সাথে বিশেষত অ্যান্ড্রোজেন এবং ইস্ট্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করতে পারে। এই মিথস্ক্রিয়াটি অকাল বয়ঃসন্ধিকালের দিকে পরিচালিত করে।
গ্যাসকিনস বলেন, 'আমাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল যে অতিরিক্ত পিএম ২.৫ এর সংস্পর্শে আসা মেয়েরা হয়ত আরও কোনো রাসায়নিকের সংস্পর্শে এসেছিলেন, যা হয় শরীরে ইস্ট্রোজেনের প্রভাব অনুকরণ অথবা এইচপিএ গ্রন্থির কার্যকলাপকে ব্যাহত করেছিল। এর ফলেই সময়ের আগে বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ ঘটেছিল তাদের।'
প্রারম্ভিক বয়ঃসন্ধি হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। পিএম ২.৫ এবং অন্যান্য দূষণকারীদের ওপর করা গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, পরিবেশের ক্ষতিকারক রাসায়নিকগুলো শরীরে প্রবেশ করে উল্লেখযোগ্য হরমোনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
গ্যাসকিন্স বলেন, 'ব্যক্তিগত প্রসাধনীর মাধ্যমেও হরমোনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসতে পারে মেয়েরা। এজন্যই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেয়েদের লক্ষ্য করে তাদের পণ্যের বিপণন করছে।'
এসকেনাজিরের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন পরিবর্তন কীভাবে শিশু বিকাশকে প্রভাবিত করছে সে সম্পর্কে আমরা এখনও অনেক কিছু জানি না। মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কারণগুলোর প্রভাব এখনও অনিশ্চিত।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা কেবল এটি বুঝতে শুরু করেছি। আমরা জানি না উষ্ণ জলবায়ু বা সামাজিক চাপ কীভাবে বয়ঃসন্ধিকালে প্রভাব ফেলছে। তবে সম্ভবত পরিবেশগত রাসায়নিক, স্থূলত্ব এবং সামাজিক কারণগুলোর কারণেই মেয়েদের অকাল বয়ঃসন্ধিকাল ঘটে থাকে।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন