মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন: স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে সবচেয়ে বড় বাধা ক্রয়ক্ষমতা
নারীর পিরিয়ডকালে স্যানিটারি ন্যাপকিন একটি অতিব জরুরি পণ্য হওয়া সত্ত্বেও, উচ্চ মূল্যের কারণে ব্যবহার বাড়ছে না পণ্যটির।
আর এই উচ্চ মূল্যের পেছনে কাজ করছে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল- অধিক শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন এয়ার লেইড পেপার, সিলিকন রিলিজ পেপার এবং অ্যাডহেসিভ টেপ আমদানিতে বিদ্যমান উচ্চ শুল্ককর।
নারীর স্বাস্থ্য রক্ষায় স্যানিটারি ন্যাপকিন জরুরি পণ্য হলেও এসব কাঁচামাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা আছে। এর বাইরে সিলিকন রিলিজ পেপার আমদানিতে ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি এবং অ্যাডহেসিভ টেপ আমদানিতে ১০ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ও ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি রয়েছে।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্কহার দেশিয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম কমানোর ক্ষেত্রে অন্তরায় উল্লেখ করে স্কয়ার ট্রয়লেটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বলেন, "এতে দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে না এবং মা-বোনদের স্বাস্থ্য ঝূঁকি থেকেই যাচ্ছে।"
আগামী বাজেটে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামাল আমদানি শুল্ক কমানোর অনুরোধ করে গত সপ্তাহে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে লেখা এক চিঠিতে অঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, "বর্তমানে স্যানিটারি ন্যাপকিনে এয়ার লেইড পেপারের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং পাল্পের ব্যবহার কমছে। অধিক শোষণ ক্ষমতার কারণে ভোক্তাদের কাছে এয়ার লেইড পেপারের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকা সত্বেও পণ্যটির কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা আছে।"
নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছর থেকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। তারপরও স্যানিটারি প্যাডের দাম এখনো বেশি, তাই সাধারণ নারীরা এর সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না।
স্কয়ার ট্রয়লেটিজের তথ্য অনুযায়ী, যারা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না তাদের ৯৭ শতাংশ সার্ভিক্যাল ইনফেকশনে ভোগেন। এই ইনফেকশন থেকে বন্ধ্যাত্ব এবং ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগেরও সৃষ্টি করতে পারে।
"৪০ শতাংশ স্কুল ছাত্রী মাসে অন্তত ৩ দিন পিরিয়ডের সময় স্কুলে উপস্থিত হতে পারে না। গার্মেন্টস কর্মীরা মাসে ৬ দিন কাজে যোগ দিতে পারে না। এতে গার্মেন্টস শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে," জানায় স্কয়ার।
এ বিষয়ে এসিআইয়ের বিজনেস ডিরেক্টর কামরুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বর্তমানে দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বাজারের আকার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা এবং প্রতিবছর এটি প্রায় ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।"
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ অনুসারে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে মাত্র ২৯ শতাংশ। ২০১৪ সালে যা ছিলো ১৪ শতাংশ।
নারীদের মধ্যে পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের হার বাড়ছে, তবে তা ধীরগতিতে। সচেতনতা কারণে শহরের অ্যাডোলেসেন্টদের মধ্যে প্যাড ব্যবহারের হার বেশি হলেও অ্যাডাল্ট ও গ্রামীণ নারীদের মধ্যে এ হার অনেক কম। পিরিয়ডের সময় কাপড়, তুলা/ টিস্যু ব্যবহার করে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন নারীরা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, স্টেসেফ, মোনালিসা, জয়া, সেনোরা, স্টেফ্রি, ফ্রিডম, হুইসপার, স্যাভলনসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্রান্ডের স্যানিটারি প্যাড বাজারে পাওয়া যায়। এক প্যাকেট প্যাডের দাম ১০০ থেকে ৩০০ টাকার মতো। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের অধিকাংশ নারীর জন্য পিরিয়ড ম্যানেজমেন্টে ১০০ টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয় না। তাই ঝুঁকি থাকলেও পুরনো কাপড় ব্যবহার করে তারা।
রংপুর শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ৫ হাজার টাকা বেতনে নার্সের চাকরি করেন আরাফাত আক্তার (২২)। সেই টাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ মিটিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে হয়। তাই ঝুঁকির বিষয়ে জানলেও বাধ্য হয়ে পিরিয়ডের সময় প্যাড ব্যবহার করেন তিনি।
আরাফাত আক্তার টিবিএসকে বলেন, "পিরিয়ডের সময় প্যাডের পেছনে ১০০ টাকা ব্যয় করা আমাদের জন্য এক ধরনের বিলাসিতা। আমার পরিবারে মা, বোন, ভাবিসহ আরো তিনজন ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারী আছে। পিরিয়ডের সময় সবাই কাপড় ব্যবহার করি।"
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শর্মিন্দ নিলোর্মি টিবিএসকে বলেন, "ভালো কোয়ালিটির স্যানিটারি প্যাডের দাম ১০০ টাকার ওপরে। যে নারী ইনকাম করেন না, পিরিয়ডের জন্য ১০০ টাকা খরচ তার পক্ষে সম্ভব নয়।"
"আবার অনেক ক্ষেত্রে মেয়েকে ঝুঁকির মধ্যে রাখতে চায়না বলে মা রা নিজে কাপড় ব্যবহার করলেও মেয়েকে প্যাড ব্যবহার করতে দেয়। এমন নয় যে মা প্যাড ব্যবহার করতে চান না; সামর্থ না থাকায় তা সম্ভব হয়না," বলেন তিনি।
এছাড়া শহরের একজন নারীর জন্য দোকান থেকে টাকা দিয়ে প্যাড কেনা যতটা সহজ, গ্রামের একজন নারী যার বাজারে যাওয়ার সুযোগ নেই তাকে তার স্বামী বা ছেলে প্যাড কিনে দিবে বিষয়টা ততোটা সহজ নয় বলে যোগ করেন শর্মিন্দ।
ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ অনুসারে, বেশিরভাগ কিশোরী মেয়ে (৫০ শতাংশ) এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারী (৬৪ শতাংশ) মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার জন্য পুরানো কাপড় ব্যবহার করে। নারীদের (২৯ শতাংশ) তুলনায় কিশোরীদের (৪৩ শতাংশ) মধ্যে নিষ্পত্তিযোগ্য প্যাড ব্যবহার করার সম্ভাবনা বেশি ছিল।
জরিপে দেখা গেছে, পুরনো কাপড় ব্যবহারকারী স্কুলছাত্রীদের মধ্যে কাপড় পরিষ্কার ও শুকানোর অনুমোদিত পদ্ধতি অনুসরণ করে ২০ শতাংশেরও কম। মাত্র ২৩ শতাংশ স্কুলছাত্রীর সাবান এবং পানিসহ উন্নত টয়লেটের অ্যাক্সেস এবং স্কুলে ব্যবহৃত মাসিকের উপকরণগুলো নিষ্পত্তি করার জায়গা রয়েছে।
রিপোর্টে আরও দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ স্কুলছাত্রী পিরিয়ডের কারণে মাসে গড়ে ২.৫ দিন অনুপস্থিত থাকে।
শর্মিন্দ নিলোর্মি বলেন, "স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের বিষয়টি যেহেতু স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে সম্পর্কিত, তাই যারা স্কুল-কলেজে পড়ে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য অন্তত সাবসিডি দিয়ে মাসে এক প্যাকেট প্যাড বিনামূল্যে দিলে ভালো হয়।"
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাবিকুন নাহার টিবিএসকে বলেন, "পিরিয়ডের সময় অপিচ্ছন্নতা ও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করে অপরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করার কারণে নারীদের ইনফেকশন, সেপটিকসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। সাধারণত গ্রামের দরিদ্র নারীরা একই কাপড় বারবার ব্যবহার করে, রোদে শুকায় না। সে কারণে তাদের জরায়ুতে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন দেখা দেয়।"
ডা. সাবিকুন নাহার আরও বলেন, "এখন স্কুল গোয়িং বাচ্চারা অনেক সচেতন, তাই তাদের মধ্যে প্যাড ব্যবহারের হার বাড়ছে। তবে বয়স্ক ও গ্রামের নারীদের মধ্যে প্যাড ব্যবহারের হার অনেক কম।"
"সার্ভিক্যাল ক্যান্সার নিয়ে যেসব রোগী আমাদের কাছে আসে তাদের অধিকাংশই প্যাডের নাম কখনো শোনেনি। ইনফেকশন মূলত সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তাই পিরিয়ডকালীন পরিচ্ছন্নতা জরুরি," বলেন তিনি।
ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮-এর তথ্যে বলা হয়েছে, প্রায় ৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং ৬ শতাংশ কিশোরী মেয়েরা জরায়ুতে চুলকানি/জ্বালা/লালভাব/ফোলা/পিণ্ড ইত্যাদি সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সমস্যার রিপোর্ট করেছে। প্রায় ৫ শতাংশ নারী এবং ৪ শতাংশ কিশোরী দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব বা অস্বাভাবিক স্রাবের কথা জানিয়েছেন।
এছাড়া, ২৮ শতাংশ কিশোরী তলপেটে ব্যথার সমস্যায় ভোগেন, যেখানে নারীদের বেলায় এই হার ১৫ শতাংশ।
আজ (২৮ মে) মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে। এবার থিম- ২০৩০ সালের মধ্যে ঋতুস্রাবকে জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে গড়ে তোলা। এবারের প্রধান লক্ষ্য, ২০৩০ এর মধ্যে এমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলা যেখানে ঋতুস্রাবের কারণে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।