ক্ষোভে ফুঁসছে কোরিয়া, ফের অভিশংসনের মুখে প্রেসিডেন্ট, ‘বিলুপ্তির’ মুখে দল, এমপিদের হত্যার হুমকি
দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘটনাপ্রবাহ এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে সংবাদপত্রগুলো আর তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। গত মঙ্গলবার রাতে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের আকস্মিক সামরিক আইন আরোপের প্রচেষ্টা এতটাই ক্ষণস্থায়ী ছিল যে সে খবর পত্রিকার প্রথম পাতায়ও স্থান পায়নি। তিনি সেনা পাঠানোর আগেই পত্রিকা ছাপা হয়ে গিয়েছিল। পরদিনের সংস্করণ ছাপা হতে হতে তার ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা ইতিমধ্যেই প্রতিহত হয়ে গিয়েছিল।
এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থনা করা মানুষ থেকে প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠলেন সাহসী ও অবিচল। অভিশংসন এড়ানোর সমস্ত প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন তিনি। যদিও তার বিরুদ্ধে তদন্তের জাল ক্রমশ গুটিয়ে আনা হচ্ছে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তদন্ত চলার সময় তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নিজ দলের মধ্যেই সমর্থন ধীরে ধীরে কমে আসায় এই সপ্তাহ শেষে দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসন ভোটের মুখোমুখি হচ্ছেন ইউন। এদিকে প্রতিদিন রাতে সড়কে হাজারো মানুষের ক্রুদ্ধ বিক্ষোভের চিৎকার ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল, ইউন তার দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পেরেছেন। তিনি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করবেন এবং এর বিনিময়ে গত শনিবারের ভোটে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে না। কিন্তু সপ্তাহের শেষে প্রেসিডেন্ট বা সেই পরিকল্পনার দেখা মিলেনি। ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পদত্যাগের বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও নেই ইউনের।
বৃহস্পতিবার তিনি সামরিক আইন জারির পক্ষে সাফাই গেয়ে ঘোষণা দেন: 'আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করব।'
তার ভাষণ ছিল অসংলগ্ন এবং ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভরপুর। ইউন দাবি করেন, যেসব নির্বাচনে তিনি পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি, সেগুলোতে উত্তর কোরিয়া আগের কারচুপি করে থাকতে পারে। তিনি বলেন, পার্লামেন্ট একটি 'দানব', বিরোধী দল 'বিপজ্জনক', আর তিনি সামরিক আইন ঘোষণা করে জনগণ ও গণতন্ত্রকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন।
এ সপ্তাহের বেশিরভাগটাই আত্মগোপনে কাটিয়েছেন ইউন। এ সময় পুলিশ তার কার্যালয়ে অভিযান চালানোর চেষ্টা করেছে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য। জনরোষ কিছুটা প্রশমিত করতে তার দল ঘোষণা দিয়েছে, ইউন আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। যদিও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিধান নেই।
এতে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে—দেশটি এখন কে চালাচ্ছে? বিশেষত ইউনের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ডাররা যখন বলে দিয়েছেন, তিনি যদি ফের সামরিক আইন আরোপের চেষ্টা করেন, তবে তারা তার আদেশ মানবেন না।
উত্তর কোরিয়ার ক্রমাগত হামলার হুমকির মধ্যে থাকা দেশটিতে এখন এক অস্বস্তিকর ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
বাইরের সবাই-ই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, এই অস্থিতিশীল এবং ঘোলাটে পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া যায় না। তবে ইউনের অভিশংসন অনিবার্য যে অনিবার্য, তা বুঝতে কিছুটা দেরি করে ফেলেছে তার দল পিপল পাওয়ার পার্টি (পিপিপি)।
প্রথমদিকে ইউনের দলের সদস্যরা তাকে রক্ষা করছিলেন। ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রক্ষায়। আর বিরোধীদলীয় নেতা লি জে-মিউংয়ের প্রতি তীব্র ঘৃণায় অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তবে কয়েকদিন বিলম্বের পর বৃহস্পতিবার পিপিপি নেতা হান দং-হুন সব পার্লামেন্ট সদস্যের প্রতি (এমপি) ইউনকে অভিশংসনের আহ্বান জানান।
অভিশংসন পাশ করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যকে এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে হবে। অর্থাৎ শাসক দলের আটজন এমপিকে বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে। ইতিমধ্যে কিছু এমপি সেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এই দলে আছেন এমপি কিম সাং-উক। তিনি বিবিসিকে বলেন, 'প্রেসিডেন্ট আর দেশ চালানোর যোগ্য নন। তিনি সম্পূর্ণ অযোগ্য।'
তবে কিম জানান, সব এমপি তার অনুগামী হবেন না। একটি দল ইউনের প্রতি অনুগত থেকেই যাবে।
কিম জানান, নিজের অতি-রক্ষণশীল নির্বাচনি এলাকায় তিনি পক্ষ বদলানোর জন্য খুনের হুমকি পেয়েছেন। 'আমার দল এবং সমর্থকরা আমাকে "বিশ্বাসঘাতক" বলছে।' দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিকে 'চরমভাবে গোত্রভিত্তিক' বলে আখ্যা দেন তিনি।
তবে বেশিরভাগ ক্ষোভের লক্ষ্য সেইসব এমপিরা, যারা এ পর্যন্ত ইউনকে রক্ষা করেছেন।
বুধবার রাতের এক বিক্ষোভে স্লোগান বদলে বিক্ষোভকারীরা বলেছেন—'ইউনকে অভিশংসন করো, দল বিলুপ্ত করো'।
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে হাজারো মানুষের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ৩১ বছর বয়সি চ্যাং ইও-হুন। তিনি বলেন, 'এখন আমি দুটোকেই [ইউন ও তার দল] ঘৃণা করি। তবে আমি মনে করি, এমপিদের প্রতি আমার ঘৃণা প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি।'
সারা সপ্তাহ ধরে এমপিরা জনসাধারণের কাছ থেকে হাজার হাজার অবমাননাকর মেসেজ ও ফোনকল পেয়েছেন। একজন এমপিকে এ ঘতনাকে 'ফোন সন্ত্রাস' আখ্যা দিয়েছেন। এমনকি কিছু এমপিকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ফুলও পাঠানো হয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় যদি পর্যাপ্তসংখ্যক এমপি ইউনকে অভিশংসনের জন্য ভোট দেন, তারপরও তার দল রাজনৈতিকভাবে বিলুপ্তির মুখোমুখি। দলটি এখন বিভক্ত এবং ব্যাপক ঘৃণার শিকার।
এমপি কিম সাং-উক মনে করেন, ভোটারদের আস্থা ফেরাতে সময় লাগবে। তিনি বলেন 'আমরা বিলুপ্ত হব না। তবে আমাদের শূন্য থেকে পুনর্গঠন করতে হবে।'
নবীন কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার যে সুনাম ছিল, তাতে গুরুতর আঘাত হেনেছেন ইউন।
শনিবার ইউন অভিশংসিত হলে তিনি বিনা যুদ্ধে ময়দান ছাড়বেন না। পেশায় আইনজীবী ইউন স্থির করেছেন, তিনি চুপচাপ সরবেন না, বরং অভিশংসনের মুখোমুখি হবেন। অসভিশংসিত হলে যাবেন আদালতে। আর তিনি যে ভূকম্পন তৈরি করে গেছেন, তার প্রভাব দেশটিকে বইতে হবে আরও অনেক বছর।
প্রতি রাতের গণবিক্ষোভের দিকে ইঙ্গিত করে কোরিয়া ইউনিভার্সিটির লিগ্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অধ্যাপক ইউন জিয়ং-ইন বলেন, দেশটি 'গণতন্ত্রের কাঠামোগত ব্যর্থতা নয়, বরং একটি অস্বাভাবিকতার' মোকাবিলা করছে।
তিনি বলেন, 'মানুষ আতঙ্কিত নয়; তারা প্রতিরোধ করছে। তারা গণতন্ত্রকে নিজের ন্যায়সংগত অধিকার হিসেবে দেখছে।'
দক্ষিণ কোরিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্মম পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে, ইউনই শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলেন। তার ভিশন ছিল, দক্ষিণ কোরিয়া 'আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র' হয়ে উঠবে এবং বৈশ্বিক মঞ্চে আরও বড় ভূমিকা পালন করবে। সিউল জি৭-এর মতো অভিজাত গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ পাবে—এমন আশাও ছিল তার।
একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বিবিসিকে বলেন, তারা এই সংকটের 'ত্বরিত সমাধান' আশা করছেন। 'দক্ষিণ কোরিয়াকে স্থিতিশীল অংশীদার হিসেবে প্রয়োজন আমাদের।'