নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তেল বিক্রি থেকে বিপুল আয় রাশিয়ার
রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর বিশ্বব্যাপী দেশটির প্রতি নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো। এসব নিষেধাজ্ঞার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া যেন যুদ্ধের খরচ চালাতে না পারে।
তা সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম ১০০ দিনের মাথায় জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ আয় করেছে রাশিয়া। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম ও রাশিয়ান তেলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ আয় হয়েছে বলে নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার-এর উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গত ১০০ দিনে রাশিয়া তেল, গ্যাস, ও কয়লা রপ্তানি করে প্রায় ৯৩ বিলিয়ন ইউরো (নয় লাখ কোটি টাকার বেশি) আয় করেছে। এ আয়ের তিন ভাগের দুই অংশ হয়েছে কেবল তেল রপ্তানি থেকে। আর বাকি আয়ের বেশিরভাগই প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি থেকে করা আয়।
'বর্তমানে রাশিয়ার এ আয়ের হার নজিরবিহীন, কারণ দামও এখন নজিরবিহীন। আর রাশিয়া এখন তাদের রেকর্ড পরিমাণের কাছাকাছি পরিমাণ জ্বালানি রপ্তানি করছে,' বলেন গবেষণাটির নেতৃত্ব দেওয়া বিশ্লেষক লাউরি মিলিভির্তা।
রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি প্রধান উপাদান হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত আয়। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্যমতে, ২০২১ সালে রাশিয়ার ফেডারেল বাজেটের ৪৫ শতাংশ ছিল তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব। বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে, জ্বালানি রপ্তানির মাধ্যমে তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করছে দেশটি।
এদিকে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানকে রাশিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে স্থগিত করার জন্য আবারও আহ্বান জানিয়েছে। "আমরা আবার বিশ্বকে অনুরোধ করছি পুতিন ও তার 'ওয়ার মেশিন'কে যেকোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা থেকে দূরে রাখতে। কিন্তু এটা করতে অনেক বেশি সময় লেগে যাচ্ছে," কিয়েভ থেকে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওলেগ উস্তেঙ্কো।
ইউক্রেন নিজেও রাশিয়ার রপ্তানির ওপর নজর রাখছে। ওলেগ উস্তেঙ্কো মনে করেন ফিনল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানের করা এ গবেষণার ফলাফল কিছুটা রক্ষণশীল। তবে তার মতেও মোটমাট ব্যাপারটা একই: রাশিয়ার যুদ্ধের খরচ আসছে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। তিনি বলেন, 'আপনারা রাশিয়ান ক্যাভিয়ার ও রাশিয়ান ভদকা আমদানি বন্ধ করতে পারেন, সেটা ভালো কথা। তবে তা যথেষ্ট নয়। আপনাদেরকে রাশিয়ান তেল আমদানি বন্ধ করতে হবে।'
বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য এড়িয়ে যাওয়ায়, দেশটির জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানির পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। তবে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে, পরিমাণ কমের ক্ষতি ভালোভাবেই পুষিয়ে নিতে পেরেছে রাশিয়া। রাশিয়ার তেল আন্তর্জাতিক বাজারের দামের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, গবেষণায় জানা গেছে, রাশিয়ার রপ্তানিকৃত জ্বালানির দাম গত বছরের তুলনায় বর্তমানে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি।
রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে কিছুটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে ইউরোপকে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রথম ১০০ দিনে গত বছরের তুলনায় রাশিয়া থেকে ২৩ শতাংশ কম প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করেছে। তা সত্ত্বেও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম-এর আয় গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
ইইউ রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ওপরও নির্ভরতা কমিয়েছে। গত মে মাসের মধ্যে রাশিয়া থেকে ক্রুড তেল আমদানি ১৮ শতাংশ কমিয়েছে তারা। কিন্তু ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনার কারণে ওই ঘাটতিও পুষিয়ে নিয়েছে রাশিয়া। ভারত বর্তমানে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের একটি বড় ক্রেতা। গত ১০০ দিনে রাশিয়ার রপ্তানির ১৮ শতাংশই হয়েছে ভারতে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়া থেকে সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে নেদারল্যান্ড ও ভারত থেকে পরিশোধিত তেলপণ্য কিনছে। এ দেশগুলো থেকে কেনা জ্বালানিপণ্যে রাশিয়ান তেল থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
গত ১০০ দিনে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে চীন। চীন রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করেছে। আর কয়লা ক্রয়ের দিক থেকে এগিয়ে আছে জাপান।
তবে সামনে আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞা আসতে যাচ্ছে। গত মাসের শেষ দিকে ইইউ নতুন আরেকটি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউরোপে রাশিয়ান তেল রপ্তানির চারভাগের তিনভাগ বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আগামী ছয় মাসের আগে এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হবে না। ব্রিটেনও জানিয়েছে এবছরের শেষ নাগাদ তারাও রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেবে। তবে হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, ও স্লোভাকিয়ার এধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার মালিকানাধীন জাহাজগুলোও এখনো রাশিয়ান তেল পরিবহন করে যাচ্ছে।
এদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার একেবারে বন্ধ করে দিয়ে তার জায়গায় নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা ইউরোপের দীর্ঘদিনের। ২০৩০ সালে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ-এ ব্যবহার বাড়িয়ে ৬৩ শতাংশে করার পরিকল্পনা করেছে ইইউ, আগে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ শতাংশের।
গত সপ্তাহে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন এর ইউরোপের মিত্রদেশগুলোর সাথে নতুন একটি কার্টেল তৈরি করার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়েছে। এ কার্টেল তৈরি হলে রাশিয়ার জ্বালানির দাম কমে এর উৎপাদন খরচের কাছাকাছি চলে আসবে। এর ফলে রাশিয়া জ্বালানি তেল থেকে বেশি আয় করতে পারবে না অথচ তাদের জ্বালানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আমদানি করতে পারবে। এ প্রক্রিয়ার ফলে জ্বালানির দামে স্থিতাবস্থা তৈরি হবে এবং বৈশ্বিক মন্দা রোধ করা যাবে।
ওলেগ উস্তেঙ্কো বলেছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এ ধরনের সাময়িক পদক্ষেপকে তারা স্বাগত জানাবেন। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোর উচিত বৈশ্বিক বাজারের দাম আর রাশিয়ার বাড়তি দামের মধ্যে পার্থক্য করে সেই বাড়তি অর্থ ইউক্রেনের জন্য কোনো সহায়তা তহবিলে দান করে দিতে।