জনশূন্য সৈকতে কুকুরের সঙ্গে ঘুমানো শিশুটির দায়িত্ব নিলেন ডিসি
করোনার সংক্রমণ রোধে গত পাঁচদিন ধরে কক্সবাজার সৈকতসহ পর্যটনস্পটে বেড়ানো নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। সে সাথে বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ রয়েছে সবধরণের পরিবহন, দোকান-পাট সবকিছু। ফলে একপ্রকার লকডাউন অবস্থায় রয়েছে পর্যটননগরী কক্সবাজার।
এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্নবিত্ত, দিনমজুর ও পর্যটক কিংবা খাবার হোটেলের উচ্ছিষ্ট চেয়ে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষগুলো। তাদেরই একজন অসহায় শিশু ইমন। গত ১০-১২দিন ধরে সৈকতকেই তার জীবন ধারণের উপজীব্য বানিয়ে থাকলেও লকডাইন অবস্থায় অন্যকোথাও না গিয়ে বালিয়াড়িতে কুকুরের সাথেই অভুক্ত ঘুমিয়ে দিন পার করছিল ইমন।
টহলে গিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ছালা মুড়িয়ে কুকুরের সাথে ঘুমন্ত অবস্থায় শিশুটিকে দেখে মুঠোফোনে ছবি ধারণ করেন কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মানস বড়ুয়া। তা তিনি ২৬ মার্চ রাত ১১টার দিকে ফেসবুকে আপলোড করে লেখেন 'সুগন্ধার মোঢ়ে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি কোথায় যাবে.?' এতে অনেকে কমেন্ট করলেও ইমনের সহায় হতে কারো ততপরতা দেখা যায়নি। কিন্তু ২৭ মার্চ রাত ১১টায় আবারো টহলে গিয়ে একই ভাবে ইমনকে আবিস্কার করেন মানস বড়ুয়া। আরেকটি ছবি নিয়ে আপলোড় দিয়ে লেখেন, 'ইমন আজও ঘুমিয়ে আছে'।
এটিই জেলা প্রশাসনের নজরে আসে। শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টায় শিশুটিকে ডিসির ডাকবাংলোতে নিয়ে গোসল করিয়ে নতুন জামা পড়িয়ে পছন্দের খাবার খাওয়ান জেলা প্রশাসক। তা জেলা প্রশাসনের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট ও এডিসির ফেসবুক আইডিতে প্রচার পেলে সবশ্রেণীর মানুষের প্রশংসায় ভাসছেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।
ওসি মানস বড়ুয়া জানান, ঘুম ভাঙিয়ে শিশুটির সাথে কথা বলে জানতে পারি তার নাম ইমন এবং বাড়ি মহেশখালী দ্বীপে। পড়তো একটি মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার মৌলভী তাকে পিটুনি দেয়ায় সে পালিয়ে কক্সবাজার আসে আর সাগরপাড়ে আশ্রয় নেয়। গত ১০-১২ দিন ধরেই নানাজনের কাছে চেয়ে খেয়ে না খেয়ে সেখানেই থাকছে। এটা জানার পর, সাথে থাকা শুকনো খাবার দিয়ে তাকে নিয়ে আসতে চাইলেও সে রাজি হয়নি। আবার শহরজুড়ে লকডাউন অবস্থা এবং চারপাশে আতংক থাকায় জোরও করা হয়নি। তার জন্য মন খারাপ লাগছিল বলেই, এফবিতে ছবি আপলোড দিয়েছিলাম।
এদিকে, শিশু ইমনকে নিয়ে আসার সবিস্তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (প্রটোকল শাখা, পর্যটন) মো. ইমরান জাহিদ খান লিখেন, পর্যটনের দায়িত্ব পাওয়ার পর কক্সবাজারের স্থানীয়গোষ্ঠীর নানা শ্রেণির লোকের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। পর্যটন নির্ভর খেটে খাওয়া এ লোকগুলোর কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্টের স্বীকার মনে হয় বীচে ঘুরে বেড়ানো ছোট ছোট বাচ্চাগুলোঃ বিশেষত যখন সে অনাথ। অনলাইনে আসেঃ এই দুর্দিনে ফাঁকা বীচে কুকুরগুলোর সাথে ছবির শিশুটি একা রাত্রি যাপন করে চলেছে গত ৮/১০দিন ধরে। বীচকর্মিদের বদান্যতায় কোন কোন বেলায় খাবার জোটে, কোন বেলায় জোটে না। আজ (২৭ মার্চ) মধ্যরাতে অনলাইনে ছেলেটির ব্যাপারটা নজরে আসে মান্যবর ডিসি স্যার-এর। এই রাতেই ডিসি স্যার বাচ্চাটিকে খুজে পাওয়া যায় কীনা সেটা দেখতে বলেন। বীচকর্মিরা শুরু করে দেয় খোঁজ করার কাজ। আমি সহকর্মী বড় ভাই সৈয়দ মুরাদকে সাথে নিয়ে যোগ দেই খোঁজাখুঁজিতে। এবং অবশেষে আমাদের এক বীচকর্মী তাকে খুঁজে পায়। এরপর ডিসি স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী ওকে নিয়ে আসি ডিসি স্যারের বাংলোয়। এরপর পরিচ্ছন্ন করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করানো। সাথে ওর গল্প শোনা, জীবনের গল্প।
বিষয়টি নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাসে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফছার লিখেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে যশোরের এ্যাসিল্যান্ড সায়েমার কর্মকান্ডে আমি লজ্জিত, দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। যে-জীবিকার তাগিদে আমি যে সার্ভিসে কাজ করি, তার কোনো সদস্য এই বর্বর আচরণ করছেন। বহু কষ্টে বহু বছরের চেষ্টায় আমরা যা অর্জন করি মানসিকভাবে অসুস্থ কেউ তা মুহুর্তেই ধ্বংস করে দেয়। তবে অনুরোধ জানাই ব্যক্তির দায় সমষ্টির উপর সাধারনীকরনের মাধ্যমে চাপিয়ে যেন না দিই আমরা।
তিনি আরও লেখেন, কক্সবাজার সৈকতে কুকুরের সাথে শুয়ে অভুক্ত থেকে দিনের পর দিন পার করা অসহায় শিশুটিকে নিজের বাংলোতে এনে গোসল করিয়ে, নতুন জামা পড়িয়ে খাবারের ব্যবস্থা যিনি করলেন এবং তার ভরনপোষনের দায়িত্ব নিলেন তিনিও প্রশাসন সার্ভিসের সদস্য- জনাব মোঃ কামাল হোসেন, জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার। সুতরাং, মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন কিংবা অমানবিকতা-অসভ্যতা প্রদর্শন তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শিক্ষার উপর নির্ভর করে-কোন সার্ভিসের অবদান বা দায় নয়।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, জেলার প্রশাসক হিসেবে সবার দেখভাল করা আমার দায়িত্বে বর্তায়। কিন্তু সবদিক একসাথে দেখা সম্ভব হয় না। যখন যেখানে যা অসামঞ্জস্য দেখি তা সমাধানের চেষ্টা করি। ইমনের বিষয়টিও এমন একটি, এটি প্রচার পেতে করা নয়। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়ার মানে হলো, যে যেখানে আছি যেভাবে পারি বিপদাপন্ন অসহায়দের সহায় হতে অনুপ্রেরণা দেয়া।