আসল বোতলে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার
শনিবার দুপুর ১২টা। চট্টগ্রামের হাজারি গলির ২১ নম্বর দোকানের সামনে বসে এক ব্যক্তি হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করছিলেন। ১০০ মিলির একটি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম রাখছিলেন ৫০ টাকা। ক্রেতারা কিনছিলেনও এসব স্যানিটাইজার।
তবে বিপত্তি বাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি টহল গাড়ি। গাড়িটি গলির দিকে আসতে দেখে বিক্রেতা হ্যান্ড স্যানিটাইজারগুলো নিয়ে পালিয়ে যান যান। পালানোর সময় কিছু বোতল সেখানে ফেলে যান। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেগুলো উদ্ধার করেন। পরে জানা যায়, হ্যান্ড স্যানিটাইজারগুলো নকল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখে তাই তারা পালিয়েছে।
শুধু হাজারি গলি নয়, চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রির খোঁজ পেয়েছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে অনেক নকল স্যানিটাইজার উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর জীবাণুনাশক সামগ্রীর ব্যবহার বেড়ে গেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব সামগ্রী বাজারে চড়া দাম বিক্রি হচ্ছে।
দেশীয় কোম্পানিগুলো হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সুযোগে একদল অসাধু ব্যবসায়ী নকল করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বাজারে বিক্রি করছে। আসল হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল সংগ্রহ করে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ভরে বাজারে বিক্রি করছে মুনাফালোভীরা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে হাজারি গলির এক ওষুধ ব্যবসায়ী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানান, পাঁচজন মিলে হ্যান্ড স্যানিটাইজারগুলো বিক্রি করছিলেন। তাদের সঙ্গে আসল হ্যান্ড স্যানিটাইজারের প্রায় পাঁচ শতাধিক খালি বোতল (অ্যাম্পুল) ও চারটি ড্রামভর্তি নীল রঙের তরল পদার্থ ছিল। এরমধ্যে একজন বয়স্ক লোক হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করছিলেন। তিনজন খালি বোতলে তরল পদার্থ ভরে বোতলজাত করছিলেন। বাকিজন কাজ করছিলেন পাহারাদার হিসেবে।
রসায়নবিদরা জানিয়েছেন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল, অ্যালোভেরা অয়েল, গ্লিসারিনসহ নানা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। মানবত্বকের সহনশীল মাত্রা অনুযায়ী এগুলো ব্যবহার করতে হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম আবে কাউছার বলেন, ল্যাবে পরিমাণ মতো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করতে হয়। উপকরণ কমবেশি হলে ত্বকের ক্ষতি হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকায় এই ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য শরীরের ব্যবহারের ফলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এসব নকল পণ্য ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত হতে গিয়ে উল্টো ত্বকের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি শরীরে চর্মরোগের বিস্তার ঘটাতে পারে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের প্রধান ডা. রফিকুল মাওলা বলেন, "নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। যেগুলো ত্বকের ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো ব্যবহার করলে ফাঙ্গাল ইনফেকশাসসহ নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। তখন জীবাণুমুক্ত হতে গিয়ে উল্টো শরীরে রোগবালাই ছড়াবে। তাই আসল এবং নকল পণ্য দেখে কিনতে হবে।"
ওষুধ প্রশাসন বলছে, একদল অসাধু ব্যক্তি বাজারে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছেড়েছে। তারা এই সুযোগ নকল পণ্য বিক্রি করে মানুষকে প্রতারিত করছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক হোসাইন মো. ইমরান বলেন, "নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারগুলো বেশিরভাগই ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা খবর পেয়েছি। নকল জীবাণুনাশক পণ্য বাজার থেকে সরাতে অভিযান চালানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, নকল পণ্যগুলো একটু খেয়াল করলেই চিনতে পারবেন ক্রেতারা। তাই ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে। ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার না কিনে রেজিস্ট্রার্ড দোকানগুলো থেকে কিনতে হবে। তখন নকল পণ্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
এদিকে নকল জীবাণুনাশক সামগ্রী বিক্রি বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি ক্রেতাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)।
সংগঠনের সহ-সভাপতি এসএম নাজির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যেকোনো সংকটে একদল অসাধু ব্যক্তি নকল পণ্য তৈরি করে ভোক্তাদের প্রতারিত করে। করোনাভাইরাসের সংকটকে পুঁজি করে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক তৈরি করে বাজার বিক্রি করছে একদল মুনাফালোভী।"
"চট্টগ্রামের হাজারি গলিতে যারা নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করছিল তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। যদি তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হতো তাহলে অন্য নকলবাজরা সতর্ক হতো। এ ছাড়া পণ্য আসল নাকি নকল সেটি যাচাই করা ভোক্তাদের কেনা উচিৎ।"