চাঁদনীঘাট, পোস্তা, ইসলামবাগ: প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের এক অচিন আজব দুনিয়া
লালবাগের রাজনারায়ণ দত্ত রোড থেকে শুরু হয়ে নন্দলাল রোড, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, হাজী বাবুল রোড, পশ্চিম ইসলামবাগসহ বুড়িগঙ্গার পাড় পর্যন্ত– পোস্তা, চাঁদনীঘাট, ইসলামবাগের প্রায় সব বাড়িই প্লাস্টিকে ভরা। কোনোটা ফ্যাক্টরি, কোনোটা দোকান।
ওষুধের দোকান থেকে মুদি দোকানে যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায়– তার প্যাকেট অথবা বোতলের ৬০ ভাগই হয় প্লাস্টিকের। এ তালিকায় সর্দি সারানোর সিরাপের বোতল, শ্যাম্পুর বোতল, ভোজ্য তেলের বোতল, বালতি, দাঁতের মাজনের পাউডার বোতল, সফট ড্রিংকস বা পানির বোতল (পেট বোতল), দইয়ের কৌটা, চকলেটের প্যাকেট, আচারের বয়াম, ঘিয়ের কৌটা, বাথরুম ক্লিনারের বোতল, জুসের বোতল, চিপসের প্যাকেটও আছে। তবে সব একই গ্রেডের প্লাস্টিক থেকে তৈরি হয় না।
যেমন বালতি, বদনা ইত্যাদি তৈরি সোল হার্ড ও চাপা দানার প্লাস্টিক থেকে। আবার শপিং ব্যাগ তৈরি হয় 'হাওয়া' দানার প্লাস্টিক থেকে। এগুলোর পোশাকি নাম এলডি (লো ডেনসিটি পলিইথিলিন), এলএলডি (লিনিয়ার লো ডেনসিটি) ইত্যাদি। আরো আছে পিপি (পলিপ্রোপাইলিন), পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) ইত্যাদি।
শামীম বেপারির থেকে জানলাম, ভার্জিন প্লাস্টিক দানা আসে সৌদি আরবসহ তেল উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশ থেকে। তেলের খনির গাদ থেকেই ভার্জিন বা অরিজিনাল দানা মিলে। তবে এখন আমাদের দেশে ব্যবহৃত প্লাস্টিক দানার ৭০ ভাগই পাওয়া যায় রিসাইক্লিইং করে।
বেশ পরিমাণে রিসাইকেলড দানা চীন ও ভারতে রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের মতো সুন্দর দানা ভারত তৈরি করতে পারে না। শামীম শুনেছেন যে, কোরীয় এবং চীনা বিনিয়োগকারীরা গাজীপুরে রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরি করেছে নিজেরাই। কারণ এখানে মজুরি কম আর শ্রমিকরা ভালো দক্ষ।
শামীম বেপারির ৩৫ বছর
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানার আব্দুল্লাপুর হাই স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়তেন শামীম '৮৬ সালে। সংসারের টানাটানির ফাঁদে পড়ে স্কুল ছাড়েন। বড় ভাই ইসলামবাগে পিপির ব্যবসায় ছিলেন আরো আগে থেকে। শামীম এসে জুটলেন তার সঙ্গে। তখন প্লাস্টিকের ব্যবহার এতো ছিল না, রিসাইক্লিং-ও বেশি হতো না, দানা বেশি আমদানিই করা হতো। শামীম বলছিলেন, মুন্সিগঞ্জের লোকেরাই ভাঙ্গারির ব্যবসা করে বেশি, তবে ব্যবসার বুদ্ধি বেশি নোয়াখালির লোকদের। নোয়াখালির লোকেরা রিসাইকেলড প্লাস্টিক দানা ছাঁচে ফেলে বদনা, বালতি, থালা করার উপায় দেখায়।
আপনি প্রথম এসে কাদেরকে বড় ব্যবসায়ী পেয়েছিলেন?
শামীম: প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের ব্যবসাটি শুরুতে অনেক ছোট ছিল। আপনি মনে করে দেখেন, নব্বইয়ের শেষ দিকেও তামা-কাসার ব্যবহার ছিল। কাঁচ আর সিরামিক পাত্রেরও ভালো ব্যবহার ছিল। তেল, মশলা ইত্যাদি প্যাকেট বা বোতলে বিক্রি হতো কম। এত রকম চানাচুর, চিপস, বিস্কুট, চকলেটও ছিল না। স্নো, ক্রিম, শ্যাম্পু, পারফিউম খুব বেশি লোকে কিনত না।
কোক-পেপসি পাওয়া যেত কাঁচের বোতলে। ওয়ান টাইমের আমল কিন্তু এল আরো পরে। আর তখন থেকে ধীরে ধীরে প্লাস্টিক বোতলে ছেয়ে যেতে থাকল বাজার। ভাঙারি ব্যবসায়ী আর রিসাইকেল ব্যবসায়ী আলাদা হয়ে গেল। ভাঙারি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও দুই ভাগ হলো, একদল ময়লা মাল মানে সিটি কর্পোরেশনের ভাগাড় থেকে মাল জোগাড় করে; অন্য দলটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাল নিয়ে আসে।
রিসাইকেল ব্যবসায়ীদের এখন অনেক দল। কেউ কসমেটিকস বোতল তৈরি করে, কেউ থালা-বালতি তৈরি করে, কেউ জুতার সোল বানায়, কেউ শুধু বোতলের ছিপি বানায়। এখন তো বড় বড় কর্পোরেটরাও এ ব্যবসায় আসছে। অনেক দানা ব্যবসায়ী এখন পোস্তা, ইসলামবাগে শাখা অফিস রেখে প্রধান অফিস করেছে মতিঝিলে।
শুরুর দিকে এসে আর কাদেরকে পেলেন?
শামীম: আপনাকে আগে ইতিহাস বলে নিলাম। প্রথমদিকে লৌহজংয়ের মন্নাফ বেপারী বড় ব্যবসায়ীরা ছিলেন। আলম সাহেবের পরিবারও বড় ব্যবসায়ী ছিল। আলম সাহেবরা গ্যালন বানাতেন। নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন তারা।
রিসাইক্লিং ব্যবসায় কয়টি দল কাজ করে?
শামীম: ভাঙারি সংগ্রাহকদের কথা বাদ দিলে থাকে দানা ও কুচা প্রস্তুতকারক। তারপর সেই দানা বা কুচা থেকে খেলনা, বোতল, বালতি, ছিপি ইত্যাদি প্রস্তুতকারক। তারপর আছে দানা ও কুচার আড়তদার এবং দানা ও কুচা রাঙানোর রঙ বিক্রেতা। এই রঙ বিদেশ থেকেই আমদানি করা হয়। মাঝখানে অনেক বেপারি ও পাইকার আছে– যারা ঘুরে ফিরে ব্যবসা করেন।
আপনি কিসের ব্যবসা করেন?
শামীম: আমি ছোট ব্যবসায়ী। নানান সময় নানান ব্যবসা করেছি। পিপি শিট বা রোলের ব্যবসা করেছি অনেকদিন। এখন দানার পাইকার। দানা দোকান থেকে কিনে ফ্যাক্টরিতে সাপ্লাই দেই। মাঝে কমিশন পাই আট আনা বা এক টাকা কেজিপ্রতি। স্টক ব্যবসাও করি। ডাল সিজনে কম দামে দানা বা কুচা কিনে রাখি; বাজার তেজি হলে দুই-চার টাকা লাভে ছেড়ে দিই।
ভাঙ্গারি থেকে দানা বা কুচা
দানা বা কুচা বিক্রি হয় পাউন্ড ধরে। ভাঙ্গারি আবার বিক্রি হয় কেজি ধরে। ভার্জিন আর রিসাইকেলড দানার দামের হেরফের বস্তা ধরে ১,৫০০ টাকার বেশি। এক বস্তায় ২৫ কেজি করে থাকে, ভার্জিন দানার বস্তা ৪০০০ টাকা যেখানে রিসাইকেলড দানার বস্তা ২৫০০ টাকা। দানার পাউন্ড ৪০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত হয়।
সবচেয়ে ভালো দানা পাওয়া যায় রোগীকে স্যালাইন দেওয়ার ব্যাগ ও তার নল থেকে। ইলেকট্রিক কেবল থেকেও ভালো দানা হয়। শামীম বললেন, 'ভালো দানা আমরা হাতে নিলে বুঝি, অনেক সময় দাঁতে কেটে বুঝি আর পোড়ালেও বোঝা যায়। যে দানায় বাষ্প হয় কম, কিন্তু গলে পড়ে ভালো সেটি ভালো দানা। কুচা হলো- কুচি কুচি করে কাটা প্লাস্টিক বোতল (সাধারণত পেট বোতল, তেলের বোতল বা কসমেটিকস বোতল)। দানা আর কুচা দুটি থেকেই ফিনিশড প্রোডাক্ট করা যায়।'
ভাঙ্গারি থেকে দানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। ভাঙ্গারি বোতলগুলো প্রথমে রঙ ধরে আলাদা করা হয়। তারপর শক্ত, নরম, ওয়ান টাইম ইত্যাদি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়।
শুধু বোতলের ছিপির জন্যও ভিন্ন সেকশন আছে। এপর্যন্ত ভাগাভাগি ভাঙারিওয়ালারাই করে। ইসলামবাগের দানা ব্যবসায়ীদের কেউ শক্ত ভাঙ্গারি কেউবা নরম ভাঙ্গারি নেন। মিক্সড মাল নেন এমন ব্যবসায়ীও আছেন।
প্রথমে দানা ফ্যাক্টরিতে এনে ভাঙ্গারিগুলো ঝেড়ে ধুলোবালি মুক্ত করা হয়, তারপর গুড়ো সাবান দিয়ে ভালো করে ধোয়া হয়; তারপর ছোট ছোট করে কাটা হয়, এরপর চোঙায় দিয়ে গুড়ো করে গলানো হয়।
গলিত প্লাস্টিক মোটা সুতা আকারে বেড়িয়ে একটি ঠান্ডা পানির চৌবাচ্চায় গিয়ে পড়ে। সেখান থেকে সুতাগুলো তুলে নিয়ে কাটার মেশিনের সঙ্গে আটকে দেওয়া হয়। কাটার মেশিন তা নির্দিষ্ট আকার বা দানা আকারে কাটতে থাকে। কুচার ক্ষেত্রে প্লাস্টিক গলানো হয় না বরং ব্লেড লাগানো চোঙায় ঢেলে কাটা হয়, হাতেও কাটা হয় কিছু। কুচাকে জীবাণুমুক্ত করতে পরে সোডা, স্পিরিট ইত্যাদি দিয়ে ধোয়া হয়।
দানা ও কুচার আড়তে চক্কর
দুই থেকে আড়াইশ দানার দোকান আছে ইসলামবাগ-পোস্তায়। চালের আড়তে যেমন মিনিকেট, বালাম বা আটাশ চাউলের বস্তা মুখ খুলে সাজিয়ে রাখা হয়, এখানেও তেমনি হরেক রঙের দানাও সাজিয়ে রাখতে দেখলাম। দানাগুলো লম্বায় আধা সেন্টিমিটার মাপের হয়। লাল, হলুদ, সবুজ, কালো, সাদা, কমলা ইত্যাদি নানা রঙের দানা হয়। কুচাও হয় এমনি বিভিন্ন রঙের।
আমরা প্লাস্টিকের তৈরি কোনো পারফিউমের বোতল হাতে নেওয়ার পর ভালো করে খেয়াল করলে দেখব– এর ছিপির ঢাকনাটা এক রঙের, আবার বোতলের মুখটা আরেক রঙের; বোতলের পাইপেরও ভিন্নতা আছে।
এবার লিপস্টিকের কোনো টিউব হাতে নিয়েও রঙের বিভিন্নতা খেয়াল করতে পারি। দানা বা কুচা রাঙানোর তাই গুরুত্ব রয়েছে। রাঙানোর পর পাউন্ডপ্রতি দানার মূল্য ১-২ টাকা বৃদ্ধি পায়। ভার্জিন দানার দোকান আলাদা হয় আর সেগুলোর বস্তার মুখও খোলা থাকে না। বস্তার গায়ে দানার ধরণ ও গ্রেড লেখা থাকে। সাধারণত ২৫ কেজিতে বস্তা হয়।
স্যান্ডেল ভাঙারি
পুরানো জুতা বা স্যান্ডেল সের দরে কিনে এনে ভাঙারিওয়ালারা জুতার ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করে। ফ্যাক্টরি কর্মীরা প্রথমে সোলটা আলাদা করে। তারপর স্যান্ডেলের ফিতা বা আপার পোরশন (ওপরভাগ) আলাদা করে রাখে।
ফ্যাক্টরিগুলো সাধারণত জুতা পরিস্কার করে না বরং বিভিন্ন মাপে কাটে। যে ফ্যাক্টরিতে যেমন মেশিন, তেমন মাপে কাটা হয় জুতা। কিছু কিছু চুঙ্গি আছে, যাতে সোল ঢেলে দিলে গুড়া গুড়া হয়ে বেড়িয়ে আসে। পরে তা গলিয়ে বড় টেবিলের ওপর ঢেলে দেওয়া হয়। ঢালার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বড় বড় রোলার দিয়ে সমান রোল তৈরি করা হয়। তারপর গরম কমে এলে ডাইস মতো কেটে নিলে নতুন সোল তৈরি হয়ে যায়।
কোনো কোনো ফ্যাক্টরিতে অবশ্য অটোমেটিক্যালি পুরো প্রক্রিয়াটি (সোল পর্যন্ত) সম্পন্ন হয়। শামীমের বন্ধু আজাদ মিয়ার বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে। তার দুই তলা কারখানা। নীচতলায় সোল তৈরি হয় আর ওপর তলায় সোলের সঙ্গে আপার জুড়ে দিয়ে পুরো স্যান্ডেলটি তৈরি করা হয়।
আপার সাধারণত চকমকে হয় আর তা বিদেশ থেকেই আমদানি করা হয় বেশি। আজাদ মিয়া বললেন, 'আমরা বস্তায় বস্তায় জুতা সেল দেই, ৬০ টাকা জোড়ার লেডিজ জুতাও পাবেন আমাদের কাছে। আবার ১২০ টাকার জুতাও আছে।' পুরুষদের আগাগোড়া প্লাস্টিক বা রাবারের জুতাও তৈরি হয় ইসলামবাগে।
শামীম দুঃখ করে বলেন, বড় বড় কোম্পানিগুলোর ফ্যাক্টরি বেশিরভাগ আমাদের এই সব জায়গায়। আমাদের দক্ষতা, আমাদের কারিগর দিয়েই তারা মাল তৈরি করে। শেষে শুধু নিজেদের নামটা বসায় জুতার গায়ে বা বালতির গায়ে। নামেই তাদের জুতা, বালতি, চেয়ারের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এর সুফল (ভালো মজুরি) কিন্তু আমরা পোস্তার মানুষ কিছু পাই না'। উল্লেখ্য স্যান্ডেলের ফিতার দানাও ভালো দামে বিক্রি হয়।
বিষ গিলে অমৃত ঢালে
ইসলামবাগ-পোস্তার শ্রমিকদের প্রায় ৫০ ভাগ নারী। পুরুষ কর্মীদের মধ্যে শিশুও আছে। বৃদ্ধ লোক এখানে কম। এখানকার বিভিন্ন গলিতে বিভিন্নরকম গন্ধ; দুর্গন্ধ বলাই ভালো। কোনো কোনো গলিতে শব্দের মাত্রা অসহনীয়। জুতার কারখানাগুলোয় ধুলা এত বেশি ওড়ে যে শ্রমিকরা ডাবল গামছা দিয়ে নাক-মুখ বেঁধে রাখে।
পুরুষ হোক বা নারী, বয়স্ক বা শিশু– এখানে সবাই আছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। পাইকার বা মহাজনরাও সে ঝুঁকির বাইরে থাকেন না। ঘণ্টা পাঁচেকের ঘোরাঘুরিতে এটাই মনে হলো শেষে, এখাকার মানুষগুলো নিজেরা বিষ গিলে উঁচুতলার মানুষদের জন্য অমৃত তৈরি করছে।
শামীমও বললেন, 'যদি এই ভাঙারিগুলো শহরের রাস্তায় গড়াগড়ি যেত বা বাড়িতে পড়ে থাকত তবে হাঁটা-চলা বা থাকা-খাওয়ার পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হতো। আমরা পেটের দায়ে এইসব পচা-গন্ধ-বাসি-ময়লা-আবর্জনা গিলছি– কিন্তু সম্মান পাচ্ছি না, টাকার মুখও দেখছে অল্প লোকই। এক থেকে দেড় লাখ লোক এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কাজ চলে দিন রাত, অথচ সরকার মনে হয়, আমাদের খবর জানেও না।'