ঋষি সুনাকের নির্বাচন যুক্তরাজ্যের জন্য নতুন দৃষ্টান্ত, কিন্তু তার পথ কতখানি মসৃণ!
অবশেষে পৃথিবী দেখলো ব্রিটিশ জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় ঋষি সুনাক পরবর্তী বৃটেনের কনজারভেটিভ দলের ২৬০ জন এমপির মধ্যে প্রায় ১৯০ জন এমপির সমর্থন লাভ করে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত হয়েছেন। তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় সরাসরি রাজা তাকে আমন্ত্রণ জানাবেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে।
বৃটেনের পার্লামেন্টের নিয়ম অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য আলাদা করে কোন শপথ গ্রহণ করার নিয়ম নেই। ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী ও পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে ব্রিটেনে বসবাস করতে আসা ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকের সংখ্যা মাত্র ১৪ লক্ষ। সেই ১৪ লক্ষের লোকের মধ্যেই ঋষি সুনাকের অবস্থান। দেশটিতে ব্লাস্ফেমি আইন আছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়ে বৃটেনের রাজনীতিতে এক বিরল ঘটনা ঘটলো সুনাকের কারণে।
মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও পূর্ব আফ্রিকার দেশ থেকে তার পিতামাতা ১৯৬০ এ ব্রিটেনে বসবাস শুরু করে। ঋষি সুনাক ব্রিটেনেই জন্ম নেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষ করেন তিনি। আদি পাঞ্জাবের হিন্দু ধর্মাবলম্বি তার পরিবার।
ভারতের একটি গণমাধ্যম ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে দিওয়ালি অর্থাৎ কালীপূজার আশীর্বাদ বলে বর্ণনা করেছে। গণমাধ্যমটি বিজেপির হিন্দুত্ববাদীতা সমর্থন করে বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ ঋষি সুনাকের এই মনোনয়নের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নাই। ব্রিটিশ সমাজে ধর্ম যে কোনো মুখ্য বিষয় নয় সেটি প্রমাণ করলো প্রধানমন্ত্রীর পদের এই মনোনয়ন।
দীর্ঘকাল যাবৎ পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী হোক কিম্বা হিন্দু জনগোষ্ঠী- বৃটেনে যারা নানান কারণে অভিবাসন করেছে, কিংবা আশ্রয় প্রার্থনা করেছে তাদের প্রায় অনেককেই বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অবিবাসনের ক্ষেত্রে ধর্ম কোন ভূমিকা পালন করেনা।
বৃটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের অনেকগুলো স্তর আছে। ১২ শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত ধর্ম গুরুদের অনুমোদন নিতে হতো কর বৃদ্ধির জন্য। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পার্লামেন্টের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নন প্রটেস্ট্যান্ট অথবা নন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের বাইরের মানুষ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাচ্ছেন।
ঋষি সুনাক আদি ভারতীয় হিন্দু ধর্মের অনুসারী। যে ধর্মের সঙ্গে ব্রিটেনের আশি শতাংশ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। এদের অনেকে জানেনই না যে ঋষি সুনাক কী ধর্ম পালন করেন এবং তার ধর্মীয় আচার-আচরণগুলো কী।
ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রটির যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্ষমতার ক্ষয়িষ্ণুতা শুরু। এবার, এই প্রথম তারা একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারল যে ধর্ম সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও দেশটিতে পার্লামেন্টে এমপি হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্য ধর্মগ্রন্থকে ব্যবহার করা হয়। নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ নেওয়ার সময় তারা রাজা/রানির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি যদি আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আসার কোনো উদাহরণ আমরা দেখতে পাই না।
ভারত যদিও এক্ষেত্রে পৃথিবীর মুসলিম সবকটি দেশ থেকে আলাদা। মুসলিম ধর্মাবলম্বী ভারতের রাষ্ট্রপতি যেমন হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ নানান পদেও মুসলিমদের দেখা গেছে। যেমন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেছেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। সেনাবাহিনীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
বাংলাদেশে বিচারবিভাগের সর্বোচ্চ পদ, প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন একজন অমুসলিম। তিনিও বিদায় নিয়েছেন দুঃখজনকভাবে। তার বিদায় কাহিনী এখনও অস্পষ্ট।
বৃটেনের জনগণের পার্লামেন্টের এই সিদ্ধান্ত, ধর্ম যে কোনো অন্তরায় হতে পারে না তা প্রমাণ করেছে। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি প্রধান অংশ ও গণমাধ্যম ঋষি সুনাকের মনোনয়নকে দিওয়ালির উপহার বলে ধর্মীয় মেরুকরণের যে প্রচেষ্টা করছে তা ব্রিটেনের মূল জনগোষ্ঠীর মানুষদের চেতনার পুরোই বিপরীত।
খুব কঠিন অর্থনৈতিক সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করছে ঋষি সুনাক। যদিও তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে বরিশ জনসনের সাথে হাত মিলিয়ে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করেছিলেন। ব্রেক্সিট সামগ্রিকভাবেই ব্রিটেনের অর্ধেক জনগোষ্ঠী গ্রহণ করেনি। তারপরেও ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের পরিণতিতে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো সেই নির্বাচনে ৫১৬ আসনের মধ্যে ২৬০ আসনে পার্টি বিজয় অর্জন করে ঋষি সুনাক ও বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি।
নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হলেন। তখন তার অর্থমন্ত্রী হিসেবেই কাজ করছিলেন সুনাক। বরিস জনসনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কোভিডের সময় তার ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের মদের পার্টির ইতিহাস যখন বেরিয়ে এলো তখন ঋষি সুনাক তার বিরোধিতা করে তার বিপক্ষে চলে যান। ফলে বরিস জনসনকে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হয়।
অন্যদিকে বরিস ক্ষমতা ত্যাগের সময় ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। প্রথম দফা যখন ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য প্রতিদ্বন্দিতা করছিলেন, বরিস জনসন তখন তার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। দলীয় ভোটারদের ভোটে ১৮ হাজারের ব্যবধানে লিজ জিতে যায় তখন।
ঋষি সুনাকের এই বিজয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বৃটেনের সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রাধান্য স্পষ্ট হলেও আদি ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী নয় বলেই মূলত ঋষি সুনাকের পিছনে তারা একত্রিত হয়েছেন।
তবে ঋষি যখন বরিস জনসনের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখনও বেশ কিছু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে লেবার পার্টি ও নিজ দলের সদস্যরাও কিন্তু বিতর্ক করেছেন। কাজেই তার ক্ষমতা কতদিন তিনি টিকিয়ে রাখতে পারেন সামনে এটাও দেখার বিষয়। কারণ বিরোধী লেবার পার্টি নির্বাচনের কথা বলছে এমনকি কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যেও নির্বাচন বিষয়ক আলোচনা চলছে। এবারকার নির্বাচনী দৌড়ে বরিস জনসনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সাথে সাথে একজন প্রাক্তন মন্ত্রী মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি নানান ভাবে বিভক্ত আর এই বিভাজন বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত ব্রেক্সিট উত্তর সময়ে। ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করেও দলটি নানানভাবে বিভাজিত ছিল। পূর্বকালেও তাদের মধ্যে নানান বিভাজন ছিল। ফলে ঋষি সুনাকের জন্য পরবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ক্ষমতা চালিয়ে যাওয়া খুবই দুর্দান্ত বিষয় হবে।
নির্বাচনের বাকি দু বছরের বেশি সময় এই সময়টা কিভাবে পার করবেন সেটি এখন বড় কথা। দলটি নানান ভাবে বিভাজিত। বরিস জনসন চাইবেন দলের নেতৃত্ব ফিরে পেতে আবার সেই কারণেই পার্লামেন্টে ঋষি সুনাকের পদক্ষেপগুলোকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করবে বরিস ও তার সমর্থক গোষ্ঠী। যে কারণে আশা করা যায় না যে বরিস জনসন দীর্ঘসময়ের তার এই প্রতিদ্বন্দ্বীকে ক্ষমতায় থাকতে দেবে।
সেই মদের পার্টি ইস্যুতে যখন দলের এমপিরা বরিস জনসনের উপর আস্থা হারিয়েছিল তখন ঋষি ছিলেন তাদের নেতৃত্বে। ফলে বরিস জনসন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও ঋষি সুনাককে কোনভাবেই ক্ষমতা পেতে দিবেন না এ ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছু মিলিয়ে সুনাকের পক্ষে দুই বছরের অধিক কাল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যে কঠিন হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।