রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় আপত্তি নেই- এমন ইঙ্গিত দিতে ইউক্রেনকে গোপনে পরামর্শ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
পুতিন ক্ষমতাচ্যুত না হলে রাশিয়ার সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়- এমন ঘোষণা থেকে সরে এসে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার প্রকাশ্য ইঙ্গিত দিতে ইউক্রেনকে গোপনে পরামর্শ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
তবে দ্য পোস্ট আরও জানিয়েছে, জোর করে ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে বসানোর কোনো উদ্দেশ্য নেই যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলছে, কিয়েভের সরকার যেন অন্যান্য দেশের সমর্থন ধরে রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা এটি।
মার্কিন কর্মকর্তাদের কিয়েভকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়ে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সহায়তা দেওয়ার নিয়মতি প্রতিশ্রুতির মাঝে এ ধরনের আলোচনায় প্রতীয়মান হচ্ছে, ইউক্রেন বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান ক্রমশ জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ইউক্রেনের মতো মার্কিন কর্তৃপক্ষও মনে করে, পুতিন আলোচনার বিষয়ে আগ্রহী নন। তবে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি'র পুতিনের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করার ঘোষণায় ইউরোপ, আফ্রিকা, ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলেও স্বীকার করে নিয়েছে মার্কিনীরা। যুদ্ধের কারণে এসব দেশকে খাবার ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে ভুগতে হচ্ছে।
এ বিষয়টি নিয়ে জেলেনস্কির একজন মুখপাত্র সেরি নিকিফরোভের সঙ্গে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনকে বর্তমান হারে আর্থিক সহায়তা করার ব্যাপারে রিপাবলিকানদের সমর্থন ক্রমেই কমে আসছে। এ মঙ্গলবারের (৮ নভেম্বর) মিডটার্ম নির্বাচনের পর হোয়াইট হাউজ হয়তো বিষয়টি নিয়ে আরও বাধার সম্মুখীন হবে।
তবে শুক্রবার কিয়েভে এক সফরে হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও দেশটি ইউক্রেনের ন্যায়সম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য সমর্থন দিয়ে যাবে।
রাশিয়ার দখল করা ভূমির অনেক অংশ ইউক্রেন পুনরায় নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসার পর এ যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আবারও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ইউক্রেনের প্রতি ইঞ্চি ভূমির জন্য লড়বেন বলে শপথ করেছেন জেলেনস্কি।
পরিস্থিতি যদি দুপক্ষের আলোচনার জন্য ক্রমশ সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা-তে সাড়া না দিয়ে পারবে না বলে মনে করেন ন্যাটের সাবেক মহাসচিব ও একসময়ে রাশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করা প্রবীণ কূটনৈতিক আলেকজান্ডার ভেরশবো।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর শান্তি আলোচনার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করেছে দেশটি।
সেপ্টেম্বরে পুতিন ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার অধিভুক্ত করলে জেলেনস্কি রাশিয়ান নেতার সঙ্গে কোনো আলোচনা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিলেন। এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, 'আমরা নতুন (রাশিয়ান) প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করব।'
শান্তি চুক্তির জন্য ইউক্রেনকে রাশিয়ার দখল করা ভূমির ওপর স্বত্ব ত্যাগ করার পরামর্শ দেয় অনেক বিদেশি শক্তি। এতে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ইউক্রেন। পশ্চিমের অনেকে ক্রেমলিনের স্বার্থ কায়েমের চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ।
ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা হলে তা হবে শয়তানের সঙ্গে চুক্তি। তাদের যুক্তি, ২০১৫ সালে পূর্ব দনবাসে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তি পুতিনকে এ বছরের পূর্ণ আক্রমণের সময় দিয়েছে। নতুন চুক্তি হলে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করে ইউক্রেন।
রাশিয়ান নেতারা কিয়েভের ওপর মস্কোর কর্তৃত্বের ওপর বিশ্বাস করে বলে তাদের সঙ্গে আলোচনা চালানোর বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে ইউক্রেন।
পুতিন এর আগে অনেকবার ইঙ্গিত করেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন একই জাতি এবং রাশিয়াই একমাত্র সঠিকভাবে ইউক্রেনকে রাষ্ট্র ও স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
ইউক্রেন ও রাশিয়া; দু'দেশেরই বিভিন্ন চরম মন্তব্যের কারণে বিশ্বব্যাপী চলমান যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ইউরোপের মানুষদের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ভুগছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোও।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি আংশিকভাবে এ যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। এর ফলে নভেম্বরের মিডটার্ম নির্বাচনের আগে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বাইডেন ও তার দল। যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে ১৮.২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সাহায্য পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর গত তিন নভেম্বর প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৮ শতাংশ রিপাবলিকান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য 'বেশি'ই করছে। গত মার্চে এ হার ছিল কেবল ছয় শতাংশ।
বিশ্বের অনেক দেশের মস্কোর সঙ্গে ভালো সুসম্পর্ক রয়েছে। আবার অনেক দেশ চাচ্ছে না, পরাশক্তিদের এ খেলায় ওয়াশিংটনের পক্ষ নিতে। আর লম্বা যুদ্ধের আশঙ্কা এ দেশগুলোতেই বেশি।
দক্ষিণ আফ্রিকা মনে করছে, বিশ্বের উচিত দোষারোপের দিকে আলোকপাত না করে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর মনোযোগ দেওয়া। ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভা তো বলেই দিয়েছেন, এ যুদ্ধের জন্য পুতিনের পাশাপাশি সমানভাবে দোষী জেলেনস্কিও।
গত মাসে দুই যুদ্ধরত দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু জেলেনস্কি সে প্রস্তাব তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
তবে এসব কিছুর পরেও মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেন, এক সময় সমঝোতাতেই রাজি হবেন জেলেনস্কি। তাদের বিশ্বাস, শীতের আগে কিয়েভ চাচ্ছে যতটা সম্ভব সামরিক সাফল্য লাভ করতে। ইউরোপে শীত নেমে এলে হয়তো কূটনৈতিক সমাধানের দ্বার খুলবে।