কয়েকশ বছর খোঁজ না মেলা বিশ্বের প্রাচীনতম কোরআন ল্যুভের প্রদর্শনীতে
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন কোরআন, উজবেকিস্তানের 'মোনালিসা' খ্যাত চিত্রসহ ইতিহাসের বেশকিছু অমূল্য নিদর্শনের প্রদর্শনী চলছে ফ্রান্সের প্যারিসে বিখ্যাত ল্যুভ মিউজিয়ামে। খবর সিএনএনের
'দ্য স্প্লেন্ডার্স অভ উজবেকিস্তান ওয়েসিস' শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে রয়েছে দেশটির অতীত সময়কে ব্যক্ত করা ১৭০টি নিদর্শন। দেওয়াল চিত্র, বুদ্ধমূর্তিসহ প্রাচীন সভ্যতাগুলোর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে জায়গা করে নিয়েছে এ আয়োজনে।
প্রদর্শনীর সহযোগী কিউরেটর হলেন পুরাতাত্ত্বিক রক্কো রান্তে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি উজবেকিস্তানের বুখারা মরুদ্যানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে জড়িত আছেন। এককালে মরুদ্যানটি ছিল সমৃদ্ধ প্রাচীন বাণিজ্যপথ– সিল্ক রুটে চলাচলকারী বণিক কাফেলাগুলোর একটি যাত্রাবিরতির স্থান। প্রাচীন এই বাণিজ্যপথ দিয়ে সুদূর প্রাচ্য থেকে ভুমধ্যসাগর পর্যন্ত চলতো বাণিজ্য।
প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ কিন্তু 'কাট্টা লঙ্গর' খ্যাত কোরআন- এর দুটি পাতা, এটি বিশ্বের প্রাচীনতম বা ইসলামের প্রাথমিক যুগের কোরআনের অনুলিপি। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত বোখারার একটি ছোট্ট গ্রামের মাজারে এটি বহু শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত ছিল। তবে এটা কতোটা প্রাচীন তা কেউই জানতো না।
রান্তে বলেন, 'উজবেক সহকর্মীদের সহায়তায় আমরা অষ্টম শতকের এই প্রাচীন কোরআনটি খুঁজে পাই, সত্যিই এটা বিশাল এক আবিষ্কার'।
উজবেকিস্তানের শিল্প ও সংস্কৃতি উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এবং লুভ মিউজিয়ামের যৌথ অংশীদারত্বে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এখানে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে শুরু করে ১,৬০০ বছর ধরে উজবেকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর অজস্র নিদর্শন– এক ছাদের নিচেই দেখার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
লুভে মিউজিয়ামের ইসলামিক শিল্প বিষয়ক সাবেক পরিচালক ও সহযোগী কিউরেটর ইয়ানিক লিন্তজের মতে, এই আয়োজনের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে সিল্ক রুট। প্রাচীন বাণিজ্য কাফেলাগুলো যেসব পথে চলাচল করতো– সেখানে সন্ধান মেলা অনেক নিদর্শন এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এটি চলবে ২০২৩ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত।
লিন্তজ বলেন, 'সবাই জানে এসব পথ ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়– এসব সড়ক বুদ্ধিবৃত্তিক, শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত লেনদেনেরও মাধ্যম ছিল'।
গ্রিক বীর আলেক্সান্ডার পা রেখেছেন সিল্ক রুটে, এপথেই মধ্য এশিয়ায় ত্রাস সঞ্চার করেছিলেন চেঙ্গিস খান ও আমির তিমুর (তৈমুর লং)। ১৪ শতকে তারা মধ্য এশিয়ায় সুবিস্তৃত সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন।
লিন্তজের মতে, 'চীন, ভারত ও পারস্যের (ইরান) মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক আদানপ্রদানকে আমরা দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে চাই। আর এ তিন ভুখণ্ডের মাঝামাঝি অবস্থিত হলো- অধুনা উজবেকিস্তান'। তাই এখানে পাওয়া নিদর্শনগুলো বহু সংস্কৃতি ও যুগের স্মারক বলেও জানান তিনি।
বহুকাল পর যেসব নিদর্শন আবারো পাদপ্রদীপের আলোয়
উজবেক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এই প্রদর্শনীতে জায়গা করে নেওয়া অনেক নিদর্শনকে তাদের পূর্বাবস্থায় ফেরানোর কাজ করেছে ল্যুভ মিউজিয়াম। সংস্কার করা এমন একটি বস্তু হলো– দক্ষিণপূর্ব উজবেকিস্তানের সমরখন্দে আমির তৈমুর লংয়ের সমাধির 'গুর-ই-আমির' নামক দরজা (কাঠামো ও দুই পাল্লাসহ)।
রান্তে বলেন, 'এই দরজায় থাকা আইকনোগ্রাফির সূত্রে আমরা সমরখন্দের তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার বর্ণনা পেয়েছি। দরজার মধ্যভাগে আমরা পাই ঈশ্বরের মহিমা বন্দনা। এছাড়া, চারপাশে বিভিন্ন প্রতীক দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি কিছু না কিছু উৎসর্গ করা হয়েছে'।
উজবেক চিত্রগুলিও সংরক্ষণ করা হয়েছে, এরমধ্যে রয়েছে চতুর্থ শতকের ভারাখশা প্রাসাদের কিছু ভাস্কর্য। বুখারা মরুদ্যানের উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত ভারাখশায় এককালে বসবাস করতো সোগদিয়ান জাতি। প্রাচীন এই পারসিক জাতি অধুনা উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান ও কিরগিজিস্থান জুড়ে বাস করতো।
ল্যুভরের প্রদর্শনীতে এই সোগদিয়ান সভ্যতার 'দ্য পেইন্টিং অভ দ্য অ্যাম্বাসেডরস' বা রাজদূতদের চিত্রও স্থান পেয়েছে। এই ছবিতে ফুটে উঠেছে প্রাচীন এক বিখ্যাত শহর আফ্রাসিয়াবের দৃশ্য। তবে ছবিটি সম্পূর্ণ নয়, বরং কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চিত্রটির আংশিক অর্থ বুঝতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা। তবে অবিকৃত না থাকলেও, এটিকে প্রাচীন কলার এক 'মাস্টারপিস' বলেই অভিহিত করেন তারা।
লিন্তজ বলেন, 'রাজদূতদের চিত্রটি উজবেক জাতির জাতীয় সম্পদ। আমি এটাকে উজেবক মোনালিসা বলব'।