সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, কল মানি রেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৭৫%
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনায় ওভারনাইট কল মানিতে সুদের হার বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৬.৭৫ শতাংশ করেছে ব্যাংকগুলো।
এ নির্দেশনার আগে ব্যাংকগুলো ওভারনাইট কল মানিতে ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ৫.৭৫ শতাংশ রেপো রেটে অন্য ব্যাংকে টাকা ধার দিতে পারতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ব্যাংকগুলো কল মানিতে কেমন সুদে টাকা ধার দেবে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিখিত কোনো নির্দেশনা নেই।
তবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কলমানিতে সুদের হার নির্ধারণ করে মৌখিকভাবে। এখানে রেপো রেটটিকে রেফারেন্স হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই রেটটিকেই কলমানিতে টাকা ধারের ম্যাক্সিমাম রেট হিসেবে রাখার জন্য বলে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ২০১৬ সালের ২ মে থেকে কল মানি রেটের ডেটা পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, গত সাড়ে ৬ বছরেরও বেশি সময়ে এতো বেশি রেটে ওভারনাইট লোন দিতে দেখা যায়নি।
অধিকাংশ সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত রেপো রেট থেকে কম হারে অন্য ব্যাংককে ওভারনাইট লোন দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তবে বাজারে লিকুইডিটি শর্টেজ দেখা দেওয়ায় রেপো রেটে ধার পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এক ব্যাংক অন্য ব্যাংককে এক দিনের জন্য যে সুদহারে টাকা ধার দেয়, সেটিকে কল মানি রেট বলে। একদিনের বেশি সময়ের জন্য ধার দেওয়া হলে ব্যাংকগুলো সেসব ধারকে শর্ট নোটিশে ধার বলে গণ্য করে।
কলমানিতে সুদের হারে বাধ্যবাধকতা থাকলেও শর্ট নোটিশে ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার নির্ধারণে ব্যাংকগুলোকে কোনো নির্দেশনা দেয় না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলো গড়ে ৬.৭০% সুদে ৩৪২৩ কোটি টাকা ওভারনাইট লোন দিয়েছে। তবে শর্ট নোটিশে লোন দেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের গড় হার ৭.৯০% থেকে ৮.৭৫% পর্যন্ত ছিল।
৭ দিনের শর্ট নোটিশে গড়ে ৮.০৪% সুদে ৪৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। বৃহস্পতিবার ওভারনাইট, শর্ট নোটিশ ও টার্ম লোন মিলিয়ে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংককে ঋণ দিয়েছে ৪৪০৬ কোটি টাকা।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সুদের হার বাড়লেও ঋণ নেওয়া কমায়নি ব্যাংকগুলো। সাধারণত সুদের হার বাড়লে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এই রেট বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাবে। যেটি আল্টিমেটলি ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটকে ছোট করবে।"
"লোনে ৯% ক্যাপ থাকার কারণে আমরা সেটিও বাড়াতে পারছি না। ফলে আমাদের ইন্টারেস্ট ইনকাম কমবে। ফরেইন ট্রান্সেকশন কমে আসায় সেখান থেকে কমিশনের প্রফিটও কমছে," যোগ করেন তিনি।
এই রেট বাড়ার কারণে লিকুইডিটি শর্টেজ খুব একটা না কমলেও একে ইন্টারেস্ট রেট বাড়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিগন্যাল হিসেবে দেখছেন এ অভিজ্ঞ ব্যাংকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, লিখিত কোনো নির্দেশনা না থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত রেপো রেটে অন্য ব্যাংকে টাকা ধার দিতে মৌখিক একটি নির্দেশনা তাদের থাকে। বৃহস্পতিবার সকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ফোন করে ওভারনাইট কল মানি রেট ১% বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তারা।
দেশের অন্যতম বড় একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, "এতদিন যে কল মানি রেটটি প্রচলিত ছিল, বর্তমান বাজারের কথা চিন্তা করলে সেটি ছিল ইনইফেক্টিভ। এ কারণে লেনদেনও হয়েছে কম। যেটুকু হয়েছে, সেগুলো ছিল মূলত নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নেওয়া লোন।"
রেটটি বাজারের চাহিদা-যোগানের উপর ছেড়ে দিলে তা ৮% এর কাছাকাছি চলে আসতে পারে বলে মন্তব্য করেন এ মানি মার্কেট বিশেষজ্ঞ।
আরেকটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, ব্যাংকগুলো ওভারনাইট লোন দেওয়ার বদলে ৪-১৪ দিনের শর্ট নোটিশে ও ৯০-১৮০ দিনের টার্মে লোন দিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ সুদের হার।
"কল মানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সুদের হার থাকলেও শর্ট নোটিশে ও টার্ম লোনের ক্ষেত্রে এসব বাধ্যবাধকতা নেই। বর্তমানে এই দুই ধরনের মেয়াদে লোনে সুদের গড় হার আছে ৮-৮.৫% এর মতো। এখানে বেশি সুদ পেলে ব্যাংক কেন ওভারনাইট কলমানিতে ধার দিয়ে নিজের ক্ষতি করবে?" বলেন তিনি।
ব্যাংকগুলোতে টাকা ধার চাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, "অনেক ব্যাংকই এখন লিকুইড সাপোর্ট চাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে সাপোর্ট দিয়ে যাওয়ার। তবে সেটা পর্যাপ্ত হচ্ছে না বলেই ব্যাংকগুলো বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের কাছে থেকে টাকা ধার করছে।"
নতুন করে রেট বাড়ানোতে সেটি মার্কেটের ওভারনাইট লোনে তেমন প্রভাব রাখবে না মন্তব্য করেন তিনি।
তথ্য বলছে, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করার কারণে চলতি অর্থবছরে দেশের বাজার থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। আবার ডিপোজিটের তুলনায় প্রাইভেট সেক্টরে ক্রেডিট গ্রোথ অনেক বেশি থাকায় টাকার চাহিদা বেড়েছে। লিকুইডিটি স্ট্রেসে থাকায় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার করাও বাড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬,২০৬ কোটি টাকা।
সেপ্টেম্বরে ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে ২৯,৬৫০ কোটি টাকা হয়। এরপর অক্টোবরে এই ঋণ ৭৯ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা এবং নভেম্বরে ৬১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।