তুরস্ক-সিরিয়া ভূমিকম্প: আর্তনাদ, কম্পন…কেমন ছিল ভূমিকম্প আঘাত হানার মুহূর্ত
ভোর তখন ৪টা ১৭ মিনিট। দক্ষিণ তুরস্কের গাজিয়ানতেপে নিজের বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন এরদিম। ওই মুহূর্তেই তুরস্কের অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্পের ধাক্কায় কেঁপে ওঠেন তিনি।
বিবিসিকে এরদিম বলেন, '৪০ বছরের জীবনে আমার কখন এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। কমপক্ষে তিনবার প্রচণ্ড কাঁপুনি টের পাই আমরা।
বিধ্বস্ত ভবন থেকে পালাতে যার যার গাড়িতে ছুটে যায়। এরদিম বলেন, 'আমার মনে হয় গাজিয়ানতেপের একটা মানুষও এখন নিজের বাড়িতে নেই।'
গাজিয়ানতেপ থেকে ১৩০ মাইল পশ্চিমের শহর আদান। ওই শহরের বাসিন্দা নিলুফার আসলান ও তার পরিবারের পাঁচতোলার অ্যাপার্টমেন্ট যখন কেঁপে ওঠে, তখন তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে বাঁচবেন না।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'জীবনে আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি। প্রায় এক মিনিট কেঁপেছিলাম আমরা।
'[পরিবারকে আমি বলি] ভূমিকম্প হচ্ছে, চলো অন্তত একসঙ্গে একজায়গায় মরি।'
ভূমিকম্প থামার পর আসলান বাইরে বেরিয়ে আসেন। 'সঙ্গে করে কিচ্ছু নিয়ে আসতে পারিনি। শুধু চপ্পল পরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।' বাইরে বেরিয়ে দেখেন, তার ভবনের আশপাশের চারটি ভবন ভেঙে পড়েছে।
৩০০ মাইল পুবের শহর দিয়ারবাকিরে ভূমিকম্প আঘাত হানার পর শহরের বাসিন্দারা উদ্ধারকর্মীদের সাহায্য করতে সড়কে ছুটে যান।
দিয়ারবাকিরের ৩০ বছর বয়সি এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, 'সব জায়গায় শুধুই আর্তনাদ। আমি দুই হাতে ইট-পাথর সরাতে শুরু করি। আমরা অনেক আহতকে উদ্ধার করেছি, কিন্তু তারপরও আর্তনাদ কমেনি। এরপর [রেসকিউ] টিম আসে।'
দিয়ারবাকিরের আরেক বাসিন্দা মুহিত্তিন ওরকাচি জানান, তার পরিবারের সাতজন সদস্য ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে।
তিনি এএফপিকে বলেন, 'আমার বোন আর ওর তিন বাচ্চা চাপা পড়েছে। ওর স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়িও চাপা পড়েছে।'
সিরিয়ার আলেপ্পোতে অনেকগুলো ভবন ধসে পড়েছে। সিরিয়ার স্বাস্থ্য পরিচালক জিয়াদ হেগ তাহা জানিয়েছেন, বিপর্যয়ের পর 'ঢেউয়ের মতো' আসছে আহতরা।
আজ ভোরে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে, সিরিয়া সীমান্তের কাছে। এতে এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১ হাজার ৪০০-র বেশি মানুষ। ঘুমের মধ্যেই মারা গেছে বহু মানুষ, ধসে পড়া ভবনের নিচে আটকা পড়েছে অসংখ্য।
ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে জানিয়েছে, গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে আঘাত হানে ৭.৮ মাত্রার এ ভূমিকম্প। তাতেই শেষ হয়নি, ৭.৮ মাত্রার
ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পর ৭.৫ মাত্রার আরেক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে তুরস্কে। অর্থাৎ একই দিনে দুবার ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল তুরস্ক ও সিরিয়া।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ৯১২।
আর সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত ও বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে অন্তত ৫৬০ জন হয়েছে।
সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা, তারতুস-এ এখন পর্যন্ত ৩৭১ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত ছয় শতাধিক। এগুলো সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রত এলাকা।
আর উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে ১৪৭ জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হেলমেটস উদ্ধার গ্রুপ।
সামনে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধাক্কায় অসংখ্য ভবন ধসে পড়েছে। উদ্ধারকর্মীরা এখন বিশাল সব ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া আহতদের জন্য অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।
ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে গাজিয়ানতেপ কাসল। ইতিহাসের স্মৃতি বহনকারী এই ভবনের বয়স ছিল ২ হাজার বছরের বেশি।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল কাহরামানমারাস প্রদেশের পাজারসিক জেলায়। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমন সোয়লু বলেছেন, ১০টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে: গাজিয়ানতেপ,
কাহরামানমারাস, হাতেই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস।
কর্মকর্তারা বলেছেন, গাজিয়ানতেপে অন্তত ৮০ জন ও কাহরামানমারাসে ৭০ জন মারা গেছে।
গাজিয়ানতেপের উত্তর-পূর্বে মালাতিয়া প্রদেশে অন্তত ৪৭ জন নিহত হয়েছে। পুবের সানলিউরফাতে মারা গেছে ১৮ জন। দিয়ারবাকির ও ওসমানিয়েসহ বিভিন্ন স্থানেও মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
তুরস্কে কমপক্ষে সাড়ে ৫ হাজার ১ সিরিয়ায় ১ হাজার মানুষ আহত হয়েছে।
দিয়ারবাকিরে বিবিসি তুর্কির সংবাদদাতা জানিয়েছেন, শহরের একটি শপিং মল ধসে পড়েছে।
লেবানন ও সাইপ্রাসেও কম্পন অনুভূত হয়েছে।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ছাত্র মোহাম্মদ এল চামা বিবিসিকে বলেন, 'আমি লিখছিলাম। হঠাৎ করেই পুরো ভবন কাঁপতে শুরু করে।'
তিনি বলেন, 'আমি ঠিক জানালার পাশেই ছিলাম। তাই ভয় পাচ্ছিলাম জানালাগুলো ভেঙে যেতে পারে। চার-পাঁচ মিনিট ধরে কম্পন চলে। খুব ভয়ঙ্কর ছিল ঘটনাটা।'
গাজা উপত্যকায় বিবিসির প্রযোজক রুশদি আবুআলুফ বলেন, তিনি যে বাড়িতে ছিলেন, সেখানে প্রায় ৪৫ সেকেন্ড কম্পন হয়েছিল।
তুরস্কের মালাতিয়া শহরের বাসিন্দা ওজগুল কনাকচি (২৫) এ ভূমিকম্পের প্রত্যক্ষদর্শী। ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া ওজগুল বলেন, চোখের সামনে ভবনের জানালাগুলো সশব্দে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখেছেন তিনি।
ভূমিকম্পের সময় ওজগুল ও তার ভাই ঘুমাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলি, "তুমি কি কাঁপছ?"
'আমি বাতির দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছিল ওটা ভেঙে যাচ্ছে। এরপর আমরা আমাদের তিন বছর বয়সী ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।'
ওজগুলদের ভবনের আশপাশের পাঁচটি ভবন ধসে গেছে। ওজগুল জানান, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের চিন্তা এখন প্রচণ্ড ঠান্ডা। তিনি কথা বলার সময় তুষারপাত হচ্ছিল।
ওজগুল বলেন, 'আমাদের চোখের সামনে আফটার শকে একটি ভবনের জানালাগুলো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।'
তিনি বলেন, 'আমাদের সাহায্য প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য দরকার আমাদের। উত্ত-পশ্চিম সিরিয়া এখন ধ্বংসস্তূপ। আমাদের জনগণকে বাঁচাতে প্রত্যেকের সাহায্য দরকার এখন।'
তুর্কি ভূমিকম্পবিদদের ধারণা, ভূমিকম্পটি ৭.৭ মাত্রার।
এর কয়েক ঘণ্টা পর দক্ষিণ তুরস্কের বেশ কয়েকটি শহরে আরেকটি শক্তিশালী আফটারশক হয়।
তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প অঞ্চলে অবস্থিত।
১৯৯৯ সালে দেশটির উত্তর-পশ্চিমে এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।