সমুদ্রে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম
ড্রেজার দিয়ে সমুদ্র থেকে বালু তুলে বাল্কহেডে রাখা হচ্ছে। বেড়িবাঁধের ভেতর দিয়ে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার পাইপলাইন বসিয়ে সমতলে বালুর স্তুপ করা হয়। পরে এসব বালু ট্রাকে করে বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজন অনুসারে বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবেই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সন্দ্বীপ চ্যানেলের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন করছেন শিপইয়ার্ড মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
সমুদুজড়ে অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বালু উত্তোলনের ফলে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশমুখ কর্ণফুলীর মোহনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নৌজেটি, পরিবেশ-জীববৈচিত্র ও উপকূলরক্ষার বেড়িবাঁধ।
অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন চলতে থাকলে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের প্রবেশমুখ কর্ণফুলীর মোহনায় প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চীফ হাইডোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের প্রভাব এখনই হয়তো পড়ছে না। তবে ভবিষ্যতে প্রভাব পড়বে। এছাড়া সন্দ্বীপ চ্যানেলে দিয়ে সন্দ্বীপ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, হাতিয়াসহ অভ্যন্তরীণ নৌরুটের পণ্যবাহী জাহাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।"
"সন্দ্বীপ চ্যানেলে জেগে ওঠা নতুন চরকে ভবিষ্যতে বে-টার্মিনালের বর্ধিত অংশ হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। এটিও ভেস্তে যাবে," বলেন তিনি।
গত সপ্তাহে জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা অভিযান পরিচালনা করলে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে।
সীতাকুণ্ডের সন্দ্বীপ চ্যানেলটিকে বালু উত্তোলনের বৈধ অঞ্চল বা বালু মহাল ঘোষণা করা হয়নি। ড্রেজিং কার্যক্রম বা বালু উত্তোলনে অনুমোদন নেই জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট কোন সংস্থার। তবুও বালু উত্তোলন থেমে নেই।
গত দুই বছরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অন্তত চার বার পরিদর্শন করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে আইনপ্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া, বাড়বকুণ্ড ও আকিলপুরের সমুদ্রে সৈকত এলাকায় তিন লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলের বিভিন্ন স্থান থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বাল্কহেড ও দুই কিমি পাইপলাইন ব্যবহার করে ডোবা ভরাট করে এসব বালুর স্তুপ রাখা হয়। এরপর ট্রাকের মাধ্যমে বালু বিক্রি করা হয়। এছাড়া সমুদ্র থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে ভরাট করা হচ্ছে নিচু জমিও।
বালু উত্তোলন, উত্তোলনের যন্ত্রপাতি ভাড়া ও জমি ভরাটের সঙ্গে মাদার স্টিল লিমিটেডের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাস্টার আবুল কাশেম, ৬ নম্বর বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর এবং ৫ নম্বর বাড়বকুন্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে সংস্থাটির পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এর আগেও গত বছর মার্চে সলিমপুর এলাকার সৈকত থেকে বালু উত্তোলনের দায়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুনকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, বালু উত্তোলনের সঙ্গে শিপইয়ার্ড মালিকদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িয়ে পড়েছেন।
এরমধ্যে ক্যাপিটাল গ্যাস, ইউরো গ্যাস, জেএমআই, ইউনি গ্যাসসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থা নিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে সমুদ্রের বালু উত্তোলনের ফলে বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এলাকার ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।"
তিনি জানান, এটি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "শিপইয়ার্ড অঞ্চলকে বালু মহাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তাই বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। এখানে রাতের আধারেও বালু উত্তোলন হয়।"
এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করতে পারে। এতে করে জড়িতদের তেমন ক্ষতি হয় না। এসব বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআইডাব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। নিয়মিত মামলা করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।"
তাছাড়া, সমুদ্রে ড্রেজিং বা বালু উত্তোলন করার পূর্বে হাইড্রোগ্রাফি সমীক্ষা করতে হয়। অর্থাৎ নদী বা সমুদ্রের তলদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ড্রেজিং বা বালু উত্তোলনের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু শিপইয়ার্ড অঞ্চলে কোন হাইড্রোগ্রাফি সমীক্ষা হয়নি। ফলে বহুমুখী সংকট ও নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে, বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে কুমিরা-সন্দ্বীপ রুটের কুমিরা জেটি ২০২২ সালের মে মাসে ভেঙে গেছে।
জেটিসংলগ্ন এলাকা থেকে বালি উত্তোলনের কারণে সন্দ্বীপ জেটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা চিঠি দিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন।
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নয়ন শীল টিবিএসকে বলেন, "অবৈজ্ঞানিক উপায়ে ড্রেজিং বা বালি উত্তোলনের কারণে নৌ-চ্যানেল ধ্বংস হচ্ছে। সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার নৌযান চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ জেটিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছি আমরা।"
চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৌপুলিশ সুপার আ ফ ম নিজাম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছি। কিন্তু অভিযানের পর তারা আবারো বালি উত্তোলন করে।"
১৯৮০ দশকে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং খাতকে ২০১১ সালে শিল্প ঘোষণা করা হয়। স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটার কারণে বিষাক্ত কেমিক্যাল সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকায় ওই সময় সীতাকুণ্ডের সাতটি মৌজায় জমি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় শিল্পজোন হিসেবে।
নানা সংকটের ফলে এই জোনের ১৬০টি শিপইয়ার্ডের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২০ থেকে ২২টি চালু আছে। বন্ধ থাকা অনেকগুলো ইয়ার্ড বর্তমানে বালু উত্তোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে।
মূলত ২০১৮ সালের দিকে সীতাকুণ্ড চ্যানেলে নতুন চর জেগে ওঠায় শিপইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপ জাহাজ ভিড়তে সমস্যা দেখা দেয়।
তখন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ থেকে একটি প্রতিষ্ঠান নিজ খরচে চরের কিছু অংশ ড্রেজিংয়ের জন্য মাত্র ছয় মাসের অনুমোদন পায়। এই চিঠিকে ব্যবহার করে পরে বেশিরভাগ শিপইয়ার্ড ড্রেজিংয়ে নেমে পড়ে। এভাবেই মূলত সমুদ্র চ্যানেলটিতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন শুরু হয়।