অশোক ও চন্দ্রগুপ্ত শাসিত ভারতের অর্থনীতি ছিল সেকালের বৈশ্বিক জিডিপির ৩২ শতাংশ
মৌর্য যুগে বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাজনৈতিক স্বত্বা ছিল ভারত। এই সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছায় বিশেষ করে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও অশোকের শাসনামলে। একজন অর্থনীতিবিদের প্রাক্কলন অনুসারে, খ্রিষ্টীয় ১ম সালে বিশ্বের মোট জিডিপির ৩২ শতাংশ ছিল ভারতের। মৌর্য যুগে যা আরো উচ্চ থাকার সম্ভাবনা আছে বলেও তিনি মতপ্রকাশ করেছেন। দ্য প্রিন্ট অবলম্বনে
কারণ, এসময়েই কৃষিকাজের ব্যাপক সম্প্রসারণ হচ্ছিল, বাড়ছিল জনসংখ্যা ও মানব বসতির আকার। দক্ষতা অনুসারে বিভিন্ন পেশার উদ্ভব ঘটছিল। সাহিত্য ও অর্থনৈতিক তথ্য লিপিবদ্ধ করতে লেখনীরও আবির্ভাব হয়। স্থল ও সাগরপথে বিভিন্ন বাণিজ্যপথ গড়ে ওঠার সুবাদে – স্থানীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য দুইয়েই নব জোয়ার দেখা দেয়।
মৌর্য যুগের সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি। এরমধ্যে অন্যতম হলো- গ্রিক ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিসের লেখা 'ইন্ডিকা' গ্রন্থ; অশোকের শিলালিপিগুলো; বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ এবং কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র'।
অর্থশাস্ত্রকে ঐতিহাসিক সূত্র হিসেবে বিবেচনা করার ব্যাপারে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, মার্ক ম্যাকক্লিশ এবং প্যাট্রিক অলিভেল লিখেছেন: "অর্থশাস্ত্রের শিক্ষা যতই অপ্রাসঙ্গিক ও আদর্শ-নির্ভর হোক তা একাধারে সমকালীন বিভিন্ন রীতি-রেওয়াজ ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড, যা কৌটিল্য তার সময়ে ঘটতে দেখেছেন"।
মৌর্য যুগ সম্পর্কে জানার অমূল্য আরেকটি উৎস দার্শনিক, সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনির লেখা 'অষ্টাধ্যায়ী' গ্রন্থ। ধারণা করা হয়, তিনি গান্ধার রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন এবং শিক্ষাগ্রহণ করেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃত ভাষার শব্দগঠন ও বাক্যরীতির সংজ্ঞা নির্ধারণ– যাতে তার সময়ে সাধারণ মানুষের কথিত 'প্রকৃত' ভাষার সঙ্গে অভিজাত শ্রেণির কথিত এবং ধর্মপুস্তকে লিখিত ভাষার ব্যবহারিক পার্থক্যগুলোকে চিহ্নিত করা যায়।
কথিত শব্দের একটি তালিকা তৈরি করেন পাণিনি, এরপর ব্যাকরণের বিভিন্ন পার্থক্য নির্দেশ করতে প্রায় ৪ হাজার সূত্র লেখেন। এসব সূত্র কাজে লাগিয়ে নতুন শব্দ উদ্ভাবনও সম্ভব হয়। ১৯ শতকের মাঝামাঝি ভাষাবিজ্ঞানে তার বিপুল অবদান সম্পর্কে জানতে পারে পশ্চিমা দুনিয়া। তাকে 'আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের জনক'-ও বলা হয়।
নানান অঞ্চলে কথিত ভাষার স্বরূপ জানতে এবং তার একটি শব্দকোষ তৈরি করতে ভারতজুড়ে ভ্রমণ করেন পাণিনি। সংগ্রহ করেন সমাজের বিভিন্ন স্তর ও সংস্কৃতির মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানান শব্দ। একাজ করতে গিয়ে তিনি মুচি, পাচক, বণিক, লেখক, ভিক্ষুক, কৃষক, পুরোহিত, রাজ-উপদেষ্টা থেকে শুরু করে প্রায় সবার সাথেই মিশেছেন।
অর্থশাস্ত্রের মতোই পাণিনির আগের যুগের ব্যাকরণবিদদের কাজের ওপর ভিত্তি করেই লেখা হয়- 'অষ্টাধ্যায়ী। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শহকে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন। তবে পন্ডিতদের সাম্প্রতিককালের গবেষণা অনুসারে, এটা খৃষ্টপূর্ব ৩৫০ সালের দিকে হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি – ঠিক এসময়েই ভারতের দোড়গোঁড়ায় এসে হাজির হন দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্ডার, যা আবার সম্রাট অশোকের শাসনকালের কাছাকাছি সময়।
নন্দ রাজাদের মধ্যে একজনের সাথে পাণিনির বন্ধুত্ব থাকার কথা উল্লেখ করেছেন গ্রিক ঐতিহাসিকরা। দার্শনিক ও মুনিদের এক সভায় যোগ দিতে তিনি পাটালিপুত্রে এসেছিলেন বলেও লিখেছেন তারা।
খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের পতঞ্জলি নামক আরেক মুনির লেখা 'মহাভাষ্য' মৌর্য যুগ সম্পর্কে জানার আরেক উৎস। সে যুগের অনেক তথ্যই উঠে এসেছে তার গ্রন্থে।
মৌর্য যুগের নগরগুলো
মৌর্য যুগের নগরগুলোর মধ্যে পাটালিপুত্র ছিল সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও ব্যস্ত এক এলাকা। তবে বুদ্ধ তার একটি বাণীতে কুশাবতী শহরের বর্ণনা দিয়েছেন:
'দিবারাত্রি রাজকীয় নগর কুশাবতীতে (কোশল রাজ্যের– বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশ) দশ ধরনের শব্দ ভেসে আসে। এই ১০ ধরনের শব্দ হলো হাতির বৃংহণ, অশ্বের হ্রেষা, রথের চাকার আওয়াজ, ডঙ্কা বা ঢাকের ধ্বনি, বাধ্যযন্ত্রের সুর; সঙ্গীতের মূর্ছনা এবং কাঁসার ঘণ্টার ধ্বনি। আর সর্বশেষটি হলো- ব্যস্ত জনতার আহার, পান ও হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ'।
নগরবাসীর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম। নগরবাসীর এ দুটি ধর্মপ্রীতির বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়েছে সেকালের ব্রাক্ষ্মণদের কিছু লিপিতে। যেমন একারণে হাটেবাজারে বেদ পাঠ করতে বারণ করা হয়েছে।
মৌর্য যুগের আরেকটি দিক সম্পর্কে জানা যায় 'কামসূত্র' গ্রন্থের মাধ্যমে। তবে অর্থশাস্ত্রের মতো এর লেখক কে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, খৃষ্টপূর্ব ৪০০ সাল থেকে ২০০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় এটি রচনা করা হয়। তবে এটিও প্রাচীন অনেক লিপির ওপর ভিত্তি করে রচয়িত।