রমজানে কেন আল-আকসা মসজিদে ইসরাইলের অভিযান?
রমজান মাস চলাকালীন সময়ে আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলের পুলিশের অভিযানের ফলে পূর্ব জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ফের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অভিযান বুধবার মধ্যরাত থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। এসময় ইসরায়েলি পুলিশ বাহিনীকে মসজিদে ঢুকে ফিলিস্তিনি পুণ্যার্থীদের ওপর চড়াও হতে দেখা যায়।
ইসরায়েলের পুলিশের দাবি, দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় তারা অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ইসরায়েলি পুলিশ পুণ্যার্থীদের নির্বিচারে লাঠিপেটা ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে।
এমনকি প্রার্থনা কক্ষে সাউন্ড বোমও নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। সোশ্যাল মিডিয়ার এক ভিডিওতে দেখা যায়, প্রার্থনা কক্ষে আগুন লেগে যাওয়ায় এক ফিলিস্তিনি নারী সাহায্যের জন্য চিৎকার করছেন।
প্যালেস্টানিয়ান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের পুলিশ এ ঘটনার সময় চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে তাদের আল-আকসা মসজিদে পৌঁছাতে বাঁধা দিয়েছে। এ অভিযানে প্রায় ১২ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক আহত হয়েছেন; যাদের মধ্যে ৩ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
আল-জাজিরার তথ্যমতে, অভিযানটিতে কমপক্ষে ৪০০ ফিলিস্তিন নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে তারা ইসরায়েলের তত্ত্বাবধানে বন্দী অবস্থায় রয়েছেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলি পুলিশ বিবৃতিতে জানায়, "আন্দোলনকারীরা মসজিদের ভেতরে পাথর, লাঠি ও আতশবাজি নিয়ে অবস্থান করছে বলে আমরা জানতে পারি। তখন পুলিশ মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে পাথর ও আতশবাজি ছুঁড়তে থাকে। আমাদের একজন পুলিশ সদস্য পায়ে আঘাতও পেয়েছেন।"
ইসরায়েলি পুলিশ আরও জানায়, আল-আকসা মসজিদ কর্তৃপক্ষের সাথে পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী কোনও পুণ্যার্থী রমজান মাসে রাতে মসজিদের ভেতর অবস্থান করতে পারবেন না। কিন্তু তারা এই চুক্তি ভঙ্গ করে রাতে মসজিদে অবস্থান করছিল।
আল-জাজিরাকে সাংবাদিক নাতাশা ঘোনেম বলেন, "পুলিশের পক্ষ থেকে পুণ্যার্থীদের শান্তিপূর্ণভাবে মসজিদের ভেতর থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তবুও তারা মসজিদের ভেতর অবস্থান করায় পুলিশ মসজিদ কমপাউন্ডের ভেতর অভিযান চালায়।"
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ ঘটনাটির নিন্দা জানিয়ে পুণ্যার্থীদের ওপর এ আচরণকে ইসরায়েলের সংগঠিত বড় ধরণের অপরাধ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, "আল-আকসা মসজিদে প্রার্থনা করার জন্য আমাদের দখলদার ইসরায়েলের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কেননা এটি আমাদের অধিকার।"
মোহাম্মদ শাতায়েহ জানান, আল-আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনের নাগরিক, আরব ও মুসলিম বিশ্বের সকলের অধিকার রয়েছে। ইসরায়েলের এ অন্যায় অভিযানের ফলে তাদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও বেগবান হবে।
গত কয়েক বছর ধরেই রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসরায়েলের পুলিশ বাহিনী কর্তৃক পুণ্যার্থীদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা ঘটছে। গতবছর রমজানেও ইসরায়েলি বাহিনী মসজিদটিতে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩০০ জন ফিলিস্তিনিকে আটক করেছিল। এছাড়াও এ ঘটনায় প্রায় ১৭০ জন ফিলিস্তিনি আহত হন। পরবর্তীতে ঐ ঘটনার জেরে গতবছরের মার্চের শেষে পশ্চিম তীর এলাকার সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং ৩৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।
একইভাবে ২০২১ সালের মে মাসে রমজানের সময় ইসরায়েলি বাহিনী আল-আকসা মসজিদের প্রার্থনাকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস, স্টান গ্রেনেড ও স্টিলের বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে শতাধিক ফিলিস্তিনি আহত হন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলের এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে।
২০২১ সালের এই ঘটনার জেরে পরবর্তীতে পূর্ব জেরুজালেমের পার্শ্ববর্তী শেখ জাররাহ অঞ্চলে ইসরায়েলের দখলদার গোষ্ঠী ও পুলিশ কর্তৃক ফিলিস্তিনি বহু পরিবারকে নির্যাতন ও জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। একইসাথে গাজা উপত্যকায় ১০ মে থেকে শুরু হয়ে টানা ১১ দিন ধরে চলে হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে সংঘাত।
ঐ ঘটনায় ৬৬ জন শিশুসহ প্রায় ২৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ১৯০০ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছিল। বিপরীতে একই ঘটনায় ইসরায়েলে দুই শিশু ও এক ভারতীয় নাগরিকসহ মোট ১৩ জন নিহত হন।
১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। যদিও এ দখল তৎকালীন সময়ে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই স্বীকৃতি পায়নি।
জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা এলাকাটি মুসলিম এবং ইহুদি-উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। ঐতিহাসিকভাবেও এটি বিবাদের ইস্যু। উভয়পক্ষই এটিকে নিজেদের বলে দাবি করে।
মুসলিমদের জন্য এই মসজিদ তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। আল-আকসা মসজিদটি যে কমপ্লেক্সে অবস্থিত মুসলিমদের কাছে সেটি আল-হারাম আল-শরীফ এবং ইহুদিদের কাছে টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত।
এ সম্পর্কে গতবছর প্যালেস্টানিয়ান সেন্টার ফর পলিসি এন্ড সার্ভে রিসার্চের পরিচালক খলিল শিকাকি আল-জাজিরাকে বলেন, "জেরুজালেমই সম্ভবত সবচেয়ে বড় ইস্যু যেটিকে কেন্দ্র করে বৃহৎ পরিসরে সহিংসতা ছড়িয়ে যেতে পারে। আমরা পূর্বেও এর প্রমাণ পেয়েছি।"
ফিলিস্তিনিরা আল-আকসাকে নিজেদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে মনে করে স্থানটির ওপর যেকোনো মূল্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চায়। তবে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
কেননা ১৯৬৭ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের দক্ষিণাংশে অবস্থিত প্রাচীনতম নগরী হেব্রনে ইব্রাহিমি মসজিদসহ অর্ধেকেরও বেশি মসজিদ সিনাগোগে রূপান্তরিত করেছে ইসরায়েল। একইভাবে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী আন্দোলনকারীরা আল-আকসা মসজিদকে ধ্বংস করে সেখানে ইহুদি মন্দির স্থাপন করতে চায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইহুদি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বড় কয়েকটি গ্রুপ পুলিশি প্রহরায় আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রায়শই যাতায়াত করছে। ঘটনাটিকে ফিলিস্তিনিরা সহিংসতা সৃষ্টিতে উস্কানি হিসেবে দেখছেন।
আবার চলতি সপ্তাহের প্রথম দিকে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ইহুদিদের পাসওভার হলিডে উপলক্ষে আল-আকসায় ভ্রমণের জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। অথচ একই সময়ে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ঐ মসজিদ প্রাঙ্গণে রমজান পালন করছেন।
এছাড়াও ফ্রিঞ্জ ইহুদি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইহুদিদের পুরনো রীতি অনুযায়ী ছাগল বলি দিতে পারলে আর্থিক উপহার দেওয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ইহুদি চরমপন্থীরা পাসওভার দিবস উপলক্ষে সেখানে একটি ছাগল জবাই করতে পারে- এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে।
এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় গত মঙ্গলবার রাতে ফিলিস্তিনিরা তারাবীহর নামাজের পর সেখানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে মসজিদে অবস্থান ও ইসরায়েলের পুলিশের অভিযানের ঘটনাটি ঘটে।