ইউয়ানেও রাখা যাবে রপ্তানি আয়
গত মাসে 'এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা'য় (ইআরকিউ) স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিজ অ্যাকাউন্টে চীনের মুদ্রা ইউয়ান রাখার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই পদক্ষেপ চীনে রপ্তানি বৃদ্ধিসহ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে এদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
এনিয়ে সাত মাসেরও কম সময়ে চীনের সাথে বাণিজ্য শক্তিশালী করার দ্বিতীয় পদক্ষেপটি নিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংকগুলোকে তাদের সংশ্লিষ্ট বিদেশি শাখায় ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের মতে, সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের একাধিক সুফল পেতে পারে বাংলাদেশ। প্রথমত, এতে করে চীনের আমদানিকারকদের ইউয়ানকে অন্য মুদ্রায় রুপান্তরের মাধ্যমে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে হবে না, ফলে দেশটির বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়বে।
এতে বাজার প্রবেশেরও উন্নতি হবে, বৈচিত্র্য আসবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে, একইসাথে কমবে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা।
এই পদক্ষেপ চীনা বিনিয়োগকেও আকৃষ্ট করতে পারে এবং বাণিজ্য সহজতর করে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতা বৃদ্ধি করে কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে সহায়তা করতে পারে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)- কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ইউয়ান রাখার অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। এর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'এটা খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ'। অবশ্য চীনে বাংলাদেশের বর্তমান রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম হওয়ায়, তাৎক্ষণিকভাবে এ পদক্ষেপের সুফল পাবে না বাংলাদেশ, কিন্তু ভবিষ্যতে এর উচ্চ সম্ভবনা রয়েছে।
সাইফুল ইসলামবলেন, 'ভবিষ্যতে চীনের বিনিয়োগ প্রবাহ আসবে, একইসাথে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণও বাড়তে পারে'।
চীন থেকে উচ্চ আমদানি ও সে তুলনায় নিম্ন রপ্তানির বিষয়ে তার সঙ্গে একমত পোষণ করে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-র চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেছেন, 'কিছু ইন্ডিভিজুয়াল এক্সপোর্টারের জন্য এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হবে। তবে এ সুযোগ থাকা দরকার। সেটি সৃষ্টি করা হয়েছে, যা ইতিবাচক'।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব আল মামুন মৃধার মতে, ইউয়ানে ইআরকিউ সুবিধা দেওয়ার ফলে রপ্তানিকারকরা উৎসাহিত হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণে এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'যারা চায়নাতে রপ্তানি করেন, তাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হবে। রপ্তানি বাড়াতেও সহায়ক হবে। পাশাপাশি চায়নিজ ইনভেষ্টমেন্ট আকর্ষণেও ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে। তবে খুব শিগগিরই বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। কারণ চায়নাতে বাংলাদেশের রপ্তানি কম'।
বাণিজ্যের তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চীনে মাত্র ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, সে তুলনায়, আমদানির পরিমাণ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পাল্লা চীনের দিকে ঝুঁকে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনবে না বলে মন্তব্য করেন পোশাক রপ্তানিকারক ও বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক।
ইআরকিউ কী?
রপ্তানি আয় দেশে আনার পর একজন রপ্তানিকারক বৈদেশিক মুদ্রার যে পরিমাণ অংশ তার ব্যাংক হিসাবে রাখতে পারেন সেটাই হলো- এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা। কাঁচামাল আমদানি, বিদেশে কোনো মূল্য পরিশোধসহ বিভিন্ন কাজে তিনি এই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করতে পারেন।
এতদিন ধরে ডলার, পাউন্ড, ইউরো ও জাপানি ইয়েনে দেশের রপ্তানিকারকদের ইআরকিউ একাউন্ট খুলত ব্যাংকগুলো। এখন চীনা ইউয়ানের জন্যেও সে সুবিধা দেওয়া হলো।
রপ্তানিকারকরা ইআরকিউ হিসাবে যে পরিমাণ অর্থ রাখতে পারবেন:
রপ্তানি পণ্যের ধরন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে তার মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে– কোন রপ্তানি আয়ের কতটা ইআরকিউ একাউন্টে নেওয়া যাবে তা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেমন, যেমন কাঁচা পাট, শাকসবজি রপ্তানির মূল্য সংযোজন ১০০ শতাংশ হওয়ায় আয়ের ৬০ শতাংশ ইআরকিউ একাউন্টে নেওয়া যায়। অন্যদিকে, মূল্য সংযোজন নিম্ন হওয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থ রাখতে পারেন।
ইআরকিউ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সহায়ক হবে– ব্যবসায়ীরা একথা কেন বলছেন:
২০২২ সালের আগস্টে ৯৯ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা অনুমোদন করে চীন।
দেশটি এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তির অধীনে এ সুবিধা দিয়েছে; যা চীন ও বাংলাদেশসহ ১৯৭৫ সালে এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি।
ইউয়ানে ইআরকিউ সুবিধা দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি চাঙ্গা হবে। চীনে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাকের বাজার রয়েছে, বাংলাদেশ যদি এই বাজারের ২ শতাংশও ধরতে পারে, তাহলে ৬ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের রপ্তানি করতে পারবে।
তাছাড়া, সাম্প্রতিক এ পদক্ষেপের ফলে এদেশে চীনের বিনিয়োগও বাড়তে পারে।
এদেশের ব্যবসায়ীদের ইআরকিউ একাউন্টে চীনা ইউয়ান রাখতে দেওয়ার ফলে– চীনের কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ করাটা সহজতর হবে। কারণ, তারা নিজেদের ইউয়ান মজুত দিয়েই এদেশে বিনিয়োগ অর্থায়ন করতে পারবে। ইউয়ানকে অন্য মুদ্রায় রুপান্তরের বাড়তি পদক্ষেপের দরকার হবে না।
তাছাড়া, বাংলাদেশ এই অঞ্চলের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হওয়ায় এবং বিপুল জনশক্তি থাকায়– নতুন বাজার ও সম্ভাবনার খোঁজে থাকা চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্যও আকর্ষণীয় গন্তব্য।
চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে ৭৮১ একর জমিতে বাংলাদেশ একটি চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন-ও গড়ে তুলছে; যা প্রথম জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) পর্যায়ে গড়ে তোলা বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল। একবার এটি চালু হলে, সেখানে চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের থেকে শিল্প প্লটের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
এছাড়া, চীন ছেড়ে বিভিন্ন কোম্পানি অন্যান্য দেশে যাচ্ছে, এদিক থেকেও আরো বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে সুবিধা লাভ করতে পারে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, চীনে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য নিয়ে উত্তেজনা এবং কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চীন সরকারের শূন্য সহনশীলতার নীতির ফলে অনেক কোম্পানি সেখান থেকে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বিশ্বের অন্যান্য দেশে সরিয়ে নিয়েছে।
ফলে বাংলাদেশের মতোন যেসব দেশে সস্তা শ্রমমূল্য ও বিশ্বের প্রধান প্রধান অর্থনীতিলোর সাথে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, তাদের রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় গন্তব্য হওয়ার সম্ভাবনা।