টাকা, রুপিতে বাণিজ্যের দিকে আরও এগিয়ে গেল ঢাকা-দিল্লি
ডলারের ওপর চাপ কমাতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের অংশবিশেষের লেনদেন নিজ নিজ মুদ্রা ব্যবহার করে নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত।
যার যার মুদ্রায় লেনদেন করতে সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক তাদের ভারতীয় ঋণদাতা স্টেট ব্যাংক অভ ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলবে। ভারতীয় ব্যাংক দুটিও বাংলাদেশি দুই ব্যাংকে একই ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলবে।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই অ্যাকাউন্টগুলো খুলতে—আন্তর্জাতিকভাবে যা ভস্ট্রো ও নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট নামে পরিচিত—স্ব স্ব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে।
সোনালী ব্যাংকের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, 'টাকা ও রুপিতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হলে ডলারের ওপর চাপ কমবে। এতে উভয় দেশই লাভবান হবে।'
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, পর্যায়ক্রমে দুই দেশের আরও ব্যাংক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে সৃষ্ট চলমান ডলারের সংকটের মধ্যে কয়েক মাস ধরেই টাকা ও রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তির বিষয়ে কথা হচ্ছে।
তবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পুরোটাই নিজস্ব মুদ্রায় হবে না।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। তাই ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ লেনদেন টাকা ও রুপিতে সম্পন্ন করবে দুই দেশ। অন্যদিকে গত অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩.৬৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২ বিলিয়ন ডলার টাকা-রুপিতে লেনদেন হলেও বাকিটা বরাবরের মতো মার্কিন ডলারে পরিশোধ করবে বাংলাদেশ।
ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, কোনো ধরনের তৃতীয় মুদ্রার অন্তর্ভূক্তি ছাড়া সরাসরি টাকা-রুপিতে লেনদেন করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
'উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পেলে আমরা গ্রাহকদের জানিয়ে দেব যে সরাসরি টাকা-রুপির মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি করা যাবে। আগ্রহী ব্যবসায়ীরা তখন সরাসরি রুপিতে এলসি খুলতে পারবেন। এতে ব্যবসায়ীদের খরচ কমবে। আবার ডলারের চাহিদায় যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেটি কমে আসবে,' বলেন তিনি।
দুই দেশের মধ্যে লেনদেন প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা করতে চলতি মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সফর করে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অভ ইন্ডিয়া এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিনিধিদল। তারা গত ১১ এপ্রিল ইবিএলে বৈঠক করে। সেখানে ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সফরকারীরা টাকা ও রুপিতে দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন পরিশোধ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক টিবিএসকে জানান, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কয়েক মাস আগে রুপিতে সরাসরি লেনদেন করার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছে।
'রিজার্ভ ব্যাংক অভ ইন্ডিয়ার এই সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশ বিষয়টি পর্যালোচনা করে টাকা ও রুপিতে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে রুপিতে এলসি খুলতে চাইলে, তা করতে পারবেন,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের লেনদেন পরিশোধে প্রক্রিয়াগত কিছু বিষয় রয়েছে।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ব্যবস্থা বাণিজ্যের প্রসার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাবে বলে মনে করছেন তারা।
গত দুই বছর ধরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। এ রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ টিবিএসকে বলেন, 'আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির সমপরিমাণ লেনদেন টাকা ও রুপিতে সম্পন্ন করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করে আসছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত সফরকালেও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা।'
বাংলাদেশ চেম্বার অভ ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ টিবিএসকে বলেন, এখন ভারতের সঙ্গে ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ (ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সমান) টাকা-রুপিতে লেনদেন করার বিষয়ে উভয় দেশই কাজ করছে।
'প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো সম্পন্ন করা হচ্ছে। তবে লেনদেন শুরু হতে কয়েক মাস লাগতে পারে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'টাকার তুলনায় রুপির বিনিময় হার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তাই রুপি-টাকায় লেনদেন শুরুর আগে আমাদের মুদ্রা আরও স্থিতিশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে।'
রাশিয়ার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। চীনও বাংলাদেশের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপের প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার চীনা প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশ ডলার সংকটে পড়েছে। এছাড়া ভূরাজনৈতিক কারণেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ডলার এড়িয়ে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
ব্রিকসভুক্ত দেশ—ভারত, রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকাও ডলার এড়িয়ে নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি শুরুর বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে।
সৌদি আরবও ইউয়ানে চীনের কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।